পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানঃ কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে এক চলমান ইতিহাস

‘গোরস্থানে সাবধান’, সত্যজিৎ রায়ের কাহিনী অবলম্বনে সন্দীপ রায় পরিচালিত এই সিনেমার বেশ কিছু দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রিতে। অবশ্য সকলের কাছে যেটি পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রি নামেই অধিক পরিচিত। ইংরেজদের আমলে তৈরি এই সিমেট্রির ইতিহাস কিন্তু বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।

এজেসি বোস রোড এবং পার্ক স্ট্রিটের সংযোগস্থলে এক বিশাল জায়গাজুড়ে বিরাজমান এই কবরস্থান। ইতিহাস বলছে, উনবিংশ শতকে এশিয়া ও ইউরোপের বাইরে অন্যতম বৃহৎ কবরস্থান হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রি। শুধু তাই নয়, চার্চবিহীন কবরস্থানের উদাহরণও ছিল পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রি, কেননা সেই সময়ের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, চার্চের সঙ্গে সিমেট্রি গড়ে ওঠাই ছিল রেওয়াজ। এখানে প্রথম কবরটি ১৭৬৭ সালের এবং তথ্য বলছে, ১৮৯৫ সালে এখানে কবর দেওয়া বন্ধ করা হয়। কবরে খোদিত স্মৃতি ফলকগুলোকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই অবশ্য এই বিষয়টি চোখে পড়বে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, কবরস্থানের প্রবেশদ্বারে যে স্মৃতি ফলকটি খোদিত আছে, সেখানে লেখা রয়েছে ১৭৯০ সালে এই কবরস্থান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
তবে কি কবরস্থান বন্ধ হওয়ার পরেও কবর দেওয়া হত?
আজ্ঞে না!
১৭৯০ সালে কবরস্থানটি বন্ধ করে দেওয়া হয় ঠিকই, কিন্তু ১৭৯৬ সালে সেটি আবার খুলে দেওয়া হয়ছিল। বর্তমানে খ্রিষ্টান বেরিয়াল বোর্ডের অধীনস্থ এই পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রি। এই পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রির উপর চাপ কমাতে ১৮৪০ সাল নাগাদ সার্কুলার রোডের পূর্বদিকে আরও একটি কবরস্থান গড়ে তোলা হয়েছিল। প্রায় ১৬০০-র কাছাকাছি স্মৃতি সৌধ রয়েছে এই গোটা সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রিতে। যার মধ্যে অবশ্য হাতে গোনা কয়েকটি সৌধ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্টেট প্রটেক্টেড মনুমেন্টের তকমা পেয়েছে।

সিমেট্রি ভালো করে ঘুরে দেখলেই কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় লক্ষ্য করা যায়। বেশিরভাগ কবরগুলির ফলকে যে জন্ম এবং মৃত্যুর তারিখ দেওয়া আছে তা থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট, এই কবরস্থানে যাদের কবর দেওয়া হয়েছিল তাদের অধিকাংশেরই বয়স তিরিশের কম। এর পেছনে অবশ্য বেশ কিছু কারণও রয়েছে। পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে কলকাতায় ইংরেজদের আসার প্রবণতা বৃদ্ধি পায় , অনেকে আবার পুরো পরিবারসমেত কলকাতায় চলে আসেন। কিন্তু কলকাতার আবহাওয়া সম্পর্কে ইংরেজ ডাক্তাররা তখনও পর্যন্ত ওয়াকিবহাল ছিলেন না, তাই কেউ কোনও ব্যাধির শিকার হলে তা নিরাময় হতে অনেক সময় লেগে যেত। যা কিনা অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনত বলে মত প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
সিমেট্রিজুড়ে চোখে পড়বে খ্যাতনামা ইংরেজদের কবর ও সৌধ। এঁর মধ্যে রয়েছেন উইলিয়াম জোন্স, হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও , এলিজা ইম্পে, চার্লস স্টুয়ার্ট প্রমুখ। এর মধ্যে অবশ্য চার্লস স্টুয়ার্টের সৌধটি বেশ কারুকার্যময়, যেখানে মধ্যযুগের শেষ দিকের মন্দির স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েছে। পদ্মাকৃতি ছাদ, পঞ্চরত্নের প্রভাব, খিলানাকৃতি প্রবেশদ্বার, চামুন্ডার খোদিত মূর্তি, যা কিনা মন্দির শিল্পের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
প্রকৃতপক্ষে চার্লস স্টুয়ার্ট আবার হিন্দু স্টুর্য়াট নামেও খ্যাত ছিলেন। বিট্রিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত সরকারি নথি থেকে জানা যায়, চার্লস স্টুয়ার্ট পেশায় ছিলেন মেজর জেনারেল। ইংরেজ-মারাঠা যুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও পালন করেছিলেন। অন্যদিকে আবার তিনি ভারতীয় ভাস্কর্যের সংগ্রাহকও ছিলেন। মূলত, মধ্য ও পূর্ব ভারত থেকে বেশ কিছু ভাস্কর্য তিনি সংগ্রহ করেন। যা নিয়ে কলকাতার উড স্ট্রিটে নিজের বাড়িতে সর্বসাধারণের জন্য একটি সংগ্রহালয়ও গড়ে তোলেন।
‘Hyde’s Notebooks'(বর্তমানে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে সংরক্ষিত)-এর লেখক জন হাইডের সৌধও রয়েছে এখানে। এই ৫৮ খন্ডের নোটবুকটিতে অবশ্য কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ামে সুপ্রিম কোর্টের প্রথমদিকের কার্যধারার বিবরণ রয়েছে। ডিরোজিও ও জোন্সের সম্পর্কে আমরা প্রত্যেকেই জানি। এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জোন্স আর তাই বর্তমানে এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃপক্ষ উইলিয়াম জোন্সের সৌধটির রক্ষণাবেক্ষন করেন। এলিজা ইম্পে আবার ছিলেন এই সুপ্রিম কোর্টের প্রথম প্রধান বিচারপতি। জর্জ মুনসুন নিজে ছিলেন সুপ্রিম কাউন্সিলের সদস্য আর তাঁর স্ত্রী লেডি অ্যানে মুনসুন ছিলেন একজন বিখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানী। মিস্টার এবং মিসেস মুনসুনের সৌধও এখানে বিরাজমান। ভ্যালেন্টাইন ব্লেকারের সৌধটিও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ, সম্রাট অশোকের মনোলিথিক পিলারের সঙ্গে যথেষ্ট মিল রয়েছে এই সৌধের। স্যান্ড স্টোন নির্মিত এই পিলারটি কবরস্থানের অন্যতম আকর্ষণ। ব্লেকার সাহেব পেশায় ছিলেন একজন উচ্চপদস্থ সেনা অফিসার।
কাকিমার সাথে কলকাতা ঘুরতে এসে মাত্র ২০ বছর বয়সে মারা যান রোজ হুউটওয়ার্থ অ্যালমার। কথায় আছে, অ্যালমার নাকি আনারস খেতে ভালবাসতেন, তাই তাঁর সৌধের উপরে আনারসের ন্যায় কারুকার্য করা হয়েছে। এই গল্পের সত্যতা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন থাকতে পারে! আসলে পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রির চারপাশে ইতিহাসের এমনই বহু রসদ বিরাজমান, যা যুগ-যুগ ধরে রহস্য তৈরি করেছে সাধারণ মানুষ থেকে গবেষকদের মধ্যে।
তবে সিমেট্রির আর একটা দিকও রয়েছে, যেগুলো এখনও সাধারণ মানুষকে শিহরিত করে। কথায় আছে, এখনও সিমেট্রির আনাচে-কানাচে কান পাতলে ইংরেজের আর্তনাদ শোনা যায়। সিমেট্রির প্রবেশদ্বার দিয়ে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়বে সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান সৌধগুলি আর তার মাঝখান দিয়ে একটা সরু রাস্তা এগিয়ে চলছে। এক একটি সৌধ যেন এক একটা ইতিহাসের পাতা। কত কিছুই না লুকিয়ে রয়েছে এই সৌধগুলির স্মৃতি ফলকে, যা এক নিমেষে আপনাকে কয়েকশ বছর পিছিয়ে নিয়ে যাবে। সকাল কিংবা পড়ন্ত বিকেল, সব সময়ই একরকম গা ছমছম করা ভাব অনুভব করা যাবেই। যদি এই গা ছমছম করা ব্যাপারটি সাথে নিয়ে ইতিহাসকে অনুভব করা যায়, তাহলে কবরস্থান ভ্রমণ করা সার্থক হবে আপনার। আর যদি ভয়টা সাথে রাখতে চান সেক্ষেত্রে হয়ত দু-একটা মামদো-র দেখা পেলেও পেতে পারেন!
কিন্তু প্রশ্ন হল রক্ষণাবেক্ষনের!
সঠিক পরিচর্যার অভাবে এখন জরাজীর্ণ অবস্থা এই গোরস্থানটির। অথচ হেরিটেজ সাইটের তকমা পাওয়ার সবরকম রসদই রয়েছে পার্ক স্ট্রিট সিমেট্রিতে। এখনও মাঝে-মাঝে বিদেশিদের দেখা যায় এখানে, যাঁরা আসেন তাঁদের পূর্বপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। যদি এই গোরস্থান সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয় তবে ইতিহাসের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে নতুন প্রজন্মের ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.