শরণার্থী শিবির থেকে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়; ‘মাঝ মাঠের শিল্পী’কে নিয়ে চিন্তিত আর্জেন্টিনাও; চিনে নিন ক্রোয়েশিয়ার LM-10’কে 

বিশ্বের বহু তারকা ফুটবলারের মতো তাঁর শৈশবও খুব একটা সহজ ছিল না। ছোটবেলা একটা বড় সময় কেটেছে শরণার্থী শিবিরে। চোখের সামনে দেখেছেন যুদ্ধের ভয়াবহতা। সেই তিনি ২০১৮ সালে বিশ্বকাপে  সেরা খেলোয়াড় হিসেবে গোল্ডেন বল পেয়েছেন। তিনি লুকা মদ্রিচ। বর্তমানে সময়ের সেরা মাঝ মাঠের খেলোয়াড়। অনেক ফুটবল প্রেমী তাঁকে ‘মাঝ মাঠের শিল্পী’ বলে। ক্রোয়েশিয়ার এল এম টেন। ক্রোয়েশিয়া বনাম আর্জেন্টিনার সেমিফাইনালে গোটা ফুটবল বিশ্ব অপেক্ষায় রয়েছে দুই এলএম টেনে’র দ্বৈরথ দেখার জন্য। 

১৯৮৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ক্রোয়েশিয়ার জাদারে লুকা মদ্রিচের জন্ম। তাঁর ছোটবেলা কেটেছে জাদার শহরের উত্তরে ভেলেবিট পবর্তের দক্ষিণ ঢালে অবস্থিত জাতোন ওব্রোভাচিক নামে একটি ছবির মতো সুন্দর গ্রামে। যদিও একটু বড় হওয়ার পরেই তিনি চলে যান মদরিচে তাঁর দাদুর বাড়িতে। সেখানেই বেশির ভাগ সময় কাটাতেন। তাঁর দাদুর নাম সিনিওর লুকা এবং মদরিচ থেকেই তাঁর নাম রাখা হয় লুকা মদ্ররিচ। কিন্তু ছোট্ট মদ্রিচের চোখের সামনেই হঠাৎ সবকিছু পাল্টে যায়। ১৯৯১ সালে ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় দাদুকে সার্বিয়ার বিদ্রোহীরা হত্যা করে। মদ্রিচদের পরিবারকে বাড়ি ছেড়ে কোল্ভারেতে চলে যেতে হয়। তাঁদের বাড়িটিও সেই সময় পুড়িয়ে ফেলা হয়। 

দীর্ঘ সাত বছর একটি ছোট্ট হোটেলে কাটাতে হয় মদ্রিচদের। কিন্তু ওই যুদ্ধের সময়েও বল থেকে দূরে থাকেননি ক্রোয়েশিয়ার অধিনায়ক। যে ছোট্ট হোটেলে তাঁরা থাকতেন তারই লনে পাথুরে জমিতে ফুটবল নিয়ে খেলতেন ছোট্ট মদ্রিচ। এরপর বাড়ি ফিরে এসে প্রকৃত অর্থে তাঁর ফুটবল অনুশীলন শুরু হয়। 

যুদ্ধ বিধ্বস্ত ক্রোয়েশিয়াতেই ১৯৯২ সালে একই সঙ্গে তিনি প্রাথমিক স্কুল এবং স্থানীয় ফুটবল একাডেমিতে ভর্তি হন। এরপর ১৯৯৬-৯৭ সালে ক্রোয়েশিয়ার স্থানীয় ক্লাব জাদারের জুনিয়র টিমে সুযোগ পান। আর এটাই ছিল তাঁর পেশাদার ফুটবলে অভিষেক। ক্রোয়েশিয়ার আরও এক ক্লাব দিনামো জাগরেবের হয়েও বেশ কিছু বছর খেলেন। তবে ২০০৮-০৯ সালটি ছিল তাঁর কেরিয়ারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সে বছর লন্ডনের টটেনহ্যাম হটস্পারে ১৬.৫ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময় যোগ দেন। যা ছিল ওই ক্লাবের ইতিহাসে সর্বাধিক ট্রান্সফার ফি। টটেনহ্যামের হয়ে মদ্রিচ ১৫৯টি ম্যাচ খেলছেন এবং ১৭ টি গোল করেছেন। এরপর ২০১২-১৩ মরশুমে ৩৫ মিলিয়ন ইউরোরের বিনিময়ে স্পেনের ক্লাব রিয়্যাল মাদ্রিদে যোগ দেন। বর্তামান তিনি রিয়্যাল মাদ্রিদেই রয়েছেন। 

মজার বিষয় ২০০৬ সালে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধেই লুকা মদ্রিচ ক্রোয়েশিয়ার জার্সিতে প্রথম মাঠে নামেন। এবং ২০০৬ সালেই জার্মানিতে জাপানের বিরুদ্ধে তাঁর বিশ্বকাপ অভিষেক ঘটে। তাঁর সময়ে ক্রোয়েশিয়া তিনটে বিশ্বকাপ খেলছে। যার মধ্যে ২০১৮ সালে তাঁর অধিনায়কত্বে ক্রোয়েশিয়া বিশ্বকাপে রানার হয়। ২০১৮ সালে ফিফার গোল্ডেন বল ছাড়াও দীর্ঘ ফুটবল জীবনে অজস্র পরুস্কার পেয়েছেন মদ্রিচ। যাঁর মধ্যে অন্যতম ব্যালন ডি’অর ২০১৮। ২০০৭ থেকে ২০ পর্যন্ত টানা ৯ বার ক্রোয়েশিয়ার বর্ষসেরা ফুটবলার হয়েছেন। ক্লাব ফুটবলেও মাদ্রিচ মোট ২২টি পুরস্কার পেয়েছেন যার মধ্যে ৬ টি দিনামো জাগরেবের হয়ে এবং ১৬টি রিয়্যাল মাদ্রিদের হয়ে। 

চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ দেখালেও ফুটবল পায়ে তিনি এক্কেবারে অন্য মানুষ। কাতার বিশ্বকাপে ব্রাজিলের মতো প্রতিপক্ষকে হারিয়েছে তাঁর দল। ৩৭ বছরের লুকা মদ্রিচ বুধবারই সম্ভবত তাঁর জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচটি খেলতে নামছেন। মদ্রিচ এবং মেসি দু’ই তারকারই এটি শেষ বিশ্বকাপ। সেমি ফাইনালের শেষ হাসি কে হাসে এখন সেদিকেই তাকিয়ে ফুটবল বিশ্ব।  

   

   

Comments are closed.