নাগপুরে গিয়ে আরএসএসকে রাজনৈতিক এবং সামাজিক বৈধতা দিয়েছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।

ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় আরএসএসের একটি সভায় নাগপুরে গিয়েছিলেন এবং সেখানে জাতি, জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ বক্তব্য পেশ করেছেন। এই কালপর্বে দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি সঙ্ঘের সভায় গিয়ে বহুত্ববাদী ভারতের যে আত্মগরিমা উপস্থাপন করেছেন তার প্রয়োজন ছিল। এই জন্যই যে, বর্তমানে ভারতে খুব সচেতনভাবে সঙ্ঘ পরিবার দেশপ্রেমিক ও দেশদ্রোহী বাইনারি তৈরি করতে চেষ্টা করছে। এই প্রচেষ্টা এতটাই মাত্রা ছাড়া হয়ে গেছে যে, তা সামগ্রিকভাবে সঙ্ঘ পরিবারের হাতেও আর নেই। ঠিক যেমন জরুরি অবস্থার বাড়াবাড়ির জন্য যতই ইন্দিরাকে দোষারোপ করা হোক, আসলে তো পুরোটাই তাঁর হাতের বাইরে চলে গিয়েছিল। ঘৃণার রাজনীতি আরও বিপজ্জনক। তা একবার লাগামছাড়া হলে কোথায় গিয়ে থামবে কেউ জানে না। নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তা আগের মতো নেই। তদুপরি সঙ্ঘ পরিবারের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দোষ থাকলেও কিছু আপাত বিচারশীল মানুষের দেখা মিলতো। জরুরি অবস্থার দুর্যোগের দিনগুলিতে তাঁরা গণতান্ত্রিক ভূমিকাও পালন করেছেন। জেল খেটেছেন। ইন্দিরাকে হারিয়ে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতেও তাঁরা সচেষ্ট ছিলেন। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। আজকের বিজেপি অতি নির্দিষ্টভাবে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করতে চাইছে। সকালে আরএসএস বিকেলে ‘অন্য কাজ’-এরকম লোকের অভাব নেই। ক্ষমতার প্রকৃতিই এমন। মতাদর্শবাদী হিন্দুত্ব (তা আমাদের পছন্দ হোক বা না হোক) ক্রমে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে লুম্পেন হিন্দুত্বকে।

নাগপুরে মোহন ভাগবত এবং প্রণব মুখোপাধ্যায়

আর ঠিক এইখানেই প্রণববাবুকে প্রয়োজন ছিল। প্রথা ভেঙে আগে বক্তৃতা করেন সঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত। তিনিও বহুত্ববাদী মতামতই পেশ করলেন। প্রণববাবু যা বললেন, তা নতুন কিছুই নয়। ভারত যে নানা ভাষা, নানা মত, নানা ধর্মের মিলনক্ষেত্র, সেটাই আর একবার মনে করিয়ে দিলেন। সঙ্ঘের অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন প্রণববাবু। তিনি শুধু সঙ্ঘকে মর্যাদা বা রাজনৈতিক, সামাজিক বৈধতাই দেননি, তাঁর নিজস্ব উচ্চতায় সঙ্ঘকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। ভারতের বিপুল বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের যে সুরটি রয়েছে, তার মূর্ছনা প্রতিধ্বনিত হয়েছে খাকি শর্টস পরা পদযুগলগুলির সদম্ভ ভূমি আস্ফালনের মধ্যে। আসমুদ্রহিমাচল টিভি বিলাসী আমরা ভেবেছি, অ্যাঁ আরএসএস কী ভাল! এই কথাগুলো শুনে নিশ্চয়ই নিজেদের পাল্টে ফেলবে ।
আর ঠিক এইখানেই খটকা লাগছে। কারণ, প্রণববাবুর ভাষণের একদিন আগেই দলিত ও মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সোমা সেনকে পুলিশ দেশদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার করেছে। তাঁর সাথেই কাকভোরে গ্রেফতার হয়েছেন আরও পাঁচজন দলিত ও মানবাধিকার কর্মী দিল্লি, মুম্বই ও পুনে থেকে। প্রণববাবুর ভাষণের কয়েক ঘন্টা আগেই বিশিষ্ট সাংবাদিক বরখা দত্ত ট্যুইট করেছেন যে, তিনি ও তাঁর পরিবার নিয়মিত হুমকি শুনছেন। তাঁর প্রশ্ন, এই কি আমার দেশ?
বরখা দত্তের প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন প্রণববাবু। ভারতের বহুত্ববাদী গণতন্ত্র এবং সামাজিক ইতিহাসের উল্লেখ করে। সাংবিধানিক আইনকে সর্বোচ্চ স্বীকৃতি দিয়ে। সামাজিক যাপনের সাথে সাংবিধানিক সত্তার মেলবন্ধনের কথার মাধ্যমে। পণ্ডিত দীনদয়াল উপাধ্যায়ের মতো তিনিও প্রাচীন ভারতীয় জনপদকে ফিরে দেখতে চেয়েছেন। সব মিলিয়ে নবরূপে সঙ্ঘ পরিবার গড়ে উঠুক, এটাই প্রণববাবুর মত। এমন একটি পরিবেশ তৈরি হোক যেখানে হেডগেওয়ার, রবীন্দ্রনাথ, জওহরলাল নেহরু একাসনে বসতে পারেন। অন্তত, সারা দেশে না হলেও, এই বঙ্গে । সাধারণ বাঙালি বড় তর্কপ্রিয় এবং ফাজিল। তাদের উপর প্রণববাবুর মতো একজন অভিভাবকের প্রভাব যদি থাকে তবে লোকসভা নির্বাচনে একটু বাড়তি সুবিধে হবে। এই যা!

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Leave A Reply

Your email address will not be published.