কুলতলির স্কুলে অস্ত্র প্রশিক্ষণ করানোর জন্য আরএসএসের চাপ, শিক্ষামন্ত্রীকে অভিযোগ জানালেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক।

দক্ষিণ ২৪ পরগনার যে ‘হিন্দু বিদ্যালয়’ স্কুলে গত ডিসেম্বরে আরএসএসের অস্ত্র প্রশিক্ষণকে কেন্দ্র করে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল, সেখানে ফের অস্ত্র প্রশিক্ষণ চালু করার জন্য প্রধান শিক্ষককে চাপ দেওয়ার অভিযোগ উঠল স্কুলের পরিচালন সমিতির বিরুদ্ধে। শুধু তাই নয়, প্রধান শিক্ষক অস্ত্র প্রশিক্ষণের বিরোধিতা করায় স্কুলের পরিচালন সমিতি তাঁকে প্রকাশ্যে হেনস্থা করছে এবং মারধরের হুমকিও দিচ্ছে বলেও অভিযোগ। এই সমস্ত অভিযোগই লিখিত আকারে কুলতলি থানায় জানিয়েছেন ‘হিন্দু বিদ্যালয়’ স্কুলের প্রধান শিক্ষক মহিমারঞ্জন মন্ডল। শুধু তাই নয়, আরএসএসের কর্মী-সদস্যদের লাগাতার হুমকির জন্য তিনি নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন বলে রাজ্য সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়ে গত শনিবার শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। পুরো বিষয়টা শুনে এ’ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে আরএসএসের অস্ত্র প্রশিক্ষণের পর থেকে এখনও পর্যন্ত কী পরিস্থিতি কুলতলির জালাবেড়িয়া এলাকার এই ‘হিন্দু বিদ্যালয়’ স্কুলে, তা জানতে thebengalstory.com এ ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মহিমারঞ্জন মন্ডলের exclusive ইন্টারভিউ।

 

মহিমারঞ্জন মন্ডল, প্রধান শিক্ষক, হিন্দু বিদ্যালয়

 

প্রশ্নঃ আপনার ‘হিন্দু বিদ্যালয়’ স্কুলে আরএসএসের অস্ত্র প্রশিক্ষণ হল, আপনি কেন তা অনুমোদন করলেন?

মহিমারঞ্জন মন্ডলঃ আমি তো অস্ত্র প্রশিক্ষণের কিছু জানতাম না। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের একটা শাখা সংগঠন ‘মানব সেবা প্রতিষ্ঠান’ এই স্কুলটা চালায়। যেহেতু বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সংগঠন দ্বারা পরিচালিত, তাই প্রো-হিন্দুত্ব একটা ভাবধারা সেই ১৯৮২ সালে স্কুল তৈরির সময় থেকেই ছিল। কিন্তু তা কখনও প্রকাশ্যে আসেনি। এর জন্য স্কুল চালাতে কোনও অসুবিধেও হচ্ছিল না। গত বছরের মাঝামাঝি থেকে এই বিষয়টা সামনে আসতে শুরু করে। স্থানীয় কিছু মানুষ এবং শিক্ষকদের নিয়ে স্কুলের একটা পরিচালন কমিটি ছিল। নিজেদের দখলে নিতে গত নভেম্বর মাসে ‘মানব সেবা প্রতিষ্ঠান’ সেই পরিচালন কমিটি ভেঙে দিয়ে ওদের জালাবেড়িয়া আশ্রম কমিটিকে স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব দেয়। তখনই আমরা বুঝতে পারছিলাম, ওদের অন্য উদ্দেশ্য আছে। এলাকার বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আরএসএস এবং সক্রিয়ভাবে বিজেপির কিছু লোককে নিয়ে এই আশ্রম কমিটি তৈরি করা হয়। তারপর থেকেই এই আশ্রম কমিটি স্কুলের সমস্ত কাজে হস্তক্ষেপ শুরু করে।

প্রশ্নঃ কিন্তু অস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যাপারটা কীভাবে এল?

মহিমারঞ্জন মন্ডলঃ গত বছর পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার পর ১৫ থেকে ২৫ ডিসেম্বর স্কুল ছুটি ছিল। সেই ছুটির মধ্যে ১৭ থেকে ২৩ ডিসেম্বর স্কুল পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আশ্রম কমিটি আরএসএসের এই অস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। আমি কিংবা অন্য শিক্ষকরা কেউই কিছু জানতাম না। আমি অস্ত্র প্রশিক্ষণের বিষয় সংবাদমাধ্যম থেকে জেনেছি। জানার পরই স্কুল খোলার পর পরিচালন কমিটিতে এর প্রতিবাদ করেছি। আর তারপর থেকেই আমার ওপর চূড়ান্ত নির্যাতন শুরু হয়েছে। ওরা আবার অস্ত্র প্রশক্ষণের জন্য চাপ দিচ্ছিল। আমি বলেছি, কোনও মতেই তা স্কুলে করা যাবে না। এরপর আমাকে স্কুলে সমস্ত শিক্ষকের সামনে হেনস্থা করে আশ্রম কমিটির সদস্যরা। প্রকাশ্যে হুমকি দেয়, মেরে আমার হাত-পা ভেঙে দেবে। স্কুলে সমস্ত শিক্ষকের সামনে চূড়ান্ত অপমান করা হয়। এরপর আমি আশ্রম কমিটির কয়েকজনের নামে কুলতলি থানায় অভিযোগ দায়ের করি।

প্রশ্নঃ আপনাকে যে এই মারধরের হুমকি দিচ্ছে, স্কুলের অন্য শিক্ষকরা কিছু বললেন না?

মহিমারঞ্জন মন্ডলঃ আশ্রম কমিটির এই অত্যাচারে দুজন শিক্ষক সন্দীপ কয়াল এবং পঞ্চানন হালদার স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন কয়েক দিন আগে। দুজন শিক্ষক অবসর নিয়েছেন। তাঁদের জায়গায় আশ্রম কমিটি দু’মাস আগে আরএসএসের তিনজন লোককে শিক্ষক পদে নিয়োগ করেছে। আমাদের সরিয়ে ওরা নিজেদের লোককে ঢুকিয়ে স্কুলটা দখলে আনতে চাইছে। বারবার চাপ দিচ্ছে স্কুলে ধর্মীয় কাজকর্ম, অস্ত্র প্রশিক্ষণ চালু করতে। আমি বাধা দিচ্ছি বলে আমাকে হেনস্থা করছে। আমি বাধা দেওয়ায় এবং পুলিশে অভিযোগ জানানোয় অস্ত্র প্রশিক্ষণ চালু করতে পারেনি ঠিকই। কিন্তু চাপ দিচ্ছে প্রচণ্ড। তাই বাধ্য হয়ে আমি কয়েক দিন আগে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে ফোন করি। তারপর শনিবার তাঁর সঙ্গে দেখা করে পুরো ঘটনা ওনাকে জানাই।

প্রশ্নঃ আপনার অভিযোগ শুনে শিক্ষামন্ত্রী কী বললেন?

মহিমারঞ্জন মন্ডলঃ উনি সবটা শুনেছেন। বলেছেন, ব্যবস্থা নেবেন। তারপর শিক্ষা দফতরের পক্ষ থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডিস্ট্রিক্ট ইন্সপেক্টের অফিস থেকে আমাকে ফোন করেছিল। বলেছে, ডিস্ট্রিক্ট ইন্সপেক্টর আমাকে ডেকে কথা বলবেন।

প্রশ্নঃ স্কুলের সিলেবাসের ব্যাপারেও কি আশ্রম কমিটি হস্তক্ষেপ করছে?

মহিমারঞ্জন মন্ডলঃ আমার মনে হচ্ছে, সেটাই ওরা করতে চায়। আমি ১৯৮২ সাল থেকে এই স্কুলে পড়াচ্ছি। বছর চারেক আগে প্রধান শিক্ষক হয়েছি। এখনও সরকারি সিলেবাসই পড়ানো হয়। কিন্তু আমার এখন মনে হচ্ছে, নিজেদের ইচ্ছেমতো সিলেবাস পড়ানোর চেষ্টা করছে আশ্রম কমিটি। তাই ওরা চায় আমাকে স্কুল থেকে তাড়াতে। তা না হলে ওরা পুরোপুরি স্কুলের দখল নিতে পারছে না। কিন্তু আমি কমিটিকে বলে দিয়েছি, যত দিন আছি ওদের সিলেবাসও চালু করতে দেব না, অস্ত্র প্রশিক্ষণও করতে দেব না। যতই চাপ আসুক।

Leave A Reply

Your email address will not be published.