সবরীমালা: মামলা বৃহত্তর বেঞ্চে পাঠিয়ে বিন্দু-কনকদুর্গাদের লড়াইকে খাটো করল সুপ্রিম কোর্ট

পাঁচে হল না সাতে গেল। ৯ নভেম্বর অযোধ্যার রায়ের পর বৃহস্পতিবার সবরীমালা মামলায় আরেক ঐতিহাসিক রায় শোনার জন্য মুখিয়ে ছিল গোটা দেশ। কিন্তু অযোধ্যা রায়ের পাঁচ দিনের মাথায় এই ধর্মীয় মামলায় ঐকমত্য হতে ব্যর্থ হলেন ৫ বিচারপতি। কেরালার সবরীমালা মন্দিরে ঋতুমতী মহিলাদের প্রবেশাধিকার নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় পুনর্বিবেচনার মামলা এ বার গেল বৃহত্তর বেঞ্চে। বৃহস্পতিবার এই নির্দেশ দিয়েছে প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ। সবরীমালার আয়াপ্পার মন্দিরে সব বয়সের মহিলাদের প্রবেশাধিকার নিয়ে কিছু দিন আগেই তোলপাড় হয়েছিল দক্ষিণের ছোট্ট রাজ্য কেরালা। পিনারই বিজয়নের নেতৃত্বাধীন বাম সরকার সুপ্রিম কোর্টের রায় কার্যকর করতে বদ্ধপরিকর ছিল। ফলে ইতিহাস নতুন করে লেখা হল সবরীমালা মন্দিরের গর্ভগৃহে। গত সেপ্টেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের গর্ভে সেই ইতিহাসের জন্ম হয়েছিল, কেরালা বাম সরকারের ভূমিকায় সেই ইতিহাসে প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়েছিল। ঋতুমতী বিন্দু ও কনকদুর্গা সেই প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অন্যদিকে, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল সংস্কার বিরোধীরা, হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী সংগঠনগুলো। ছড়িয়েছিল হিংসাও। আর তার আঁচ গিয়ে পড়েছিল গোটা দেশে। শুরু হয়েছিল ছিল আইনি লড়াই। সেই রায় পুনর্বিবেচনার জন্য কমপক্ষে ৬৫ টি আবেদন জমা পড়েছিল শীর্ষ আদালতে। এদিকে, বাবরি মসজিদ নিয়ে রায়ের সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জাতির উদ্দেশে এরকম একটা কথা বলেছেন যে এক সোনালি যুগের সূচনা হল। অর্থাৎ, ঠারেঠোরে জানিয়ে দিলেন, রায়টা ওঁদের অনুকূলে গেছে। ফলে, ওই রায়ের স্টেরয়েডে উজ্জীবিত হিন্দুদের বৃহদাংশের বৃহস্পতিবার সবরীমালার রায় নিয়ে গভীর আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু, অযোধ্যার বিতর্কিত জমির মালিকানা নিয়ে মামলা যত সহজে জজসাহেবরা সালটে দিতে পেরেছেন, এক্ষেত্রে তা হল না। প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ সহমত হতে পারল না। ফলে আরও একটি ঐতিহাসিক রায়ের কারিগর হতে পারলেন না প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ।
সুপ্রিম কোর্টে মাত্র চার দিন আগে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ ‘সর্বসম্মত’ রায়ে যেসব যুক্তি দিয়েছেন, তার মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দের গদ্য ধার করে বিবেচনা করে দেখা যাবে ১৪ আনা আস্থা, ৩ ছটাক ভাবাবেগ, ৪ ছটাক পুরাণ, আর বাকিটা আইন। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, হিন্দুরা মনে করে এটা রামের জন্মভূমি এবং এই ধরনের বিশ্বাসী হিন্দুর সংখ্যা অনেক—আর সেটাই ধর্মাবতারদের কাছে যথেষ্ট গ্রাহ্য একটা যুক্তি।
জানি না, আইনের কাছে বিশ্বাসটা আদৌ কী করে যুক্তি বলে মনে হল? আমরা তো নয়, আইনের ব্যাপারে নভিস, কিন্তু শীর্ষ আদালতের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গাঙ্গুলি মহাশয়? আইনের ছাত্র হিসেবে তিনিও তো কতগুলো টেকনিক্যাল প্রশ্ন তুলেছেন, যা আগে ভাগে অনেকের মাথায় আসেনি। তবু সুপ্রিম কোর্টের এই রায় প্রায় সব রাজনৈতিক দল ও মতের লোকেরা খুশি। আর তাই সবরীমালার রায় নিয়ে একটা বাড়তি উৎসাহ তলে তরে কাজ করছিল।
মন্দিরে মহিলাদের প্রবেশাধিকার থাকবে কি না, তা নিয়ে একমত হতে পারেননি বিচারপতিরা। তাই সাত সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চে এই মামলা পাঠানো হল। নতুন প্রধান বিচারপতি এস এ বোবদের নেতৃত্বে এই মামলার শুনানি হবে। প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ এদিন স্পষ্টই জানিয়ে দেন, শুধুমাত্র সবরীমালা মন্দিরই নয়, অন্য ধর্মের উপাসনা স্থানেও মহিলাদের প্রবেশাধিকারের ওপরে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
তাই সবরীমালার আয়াপ্পা মন্দিরে সব বয়সী মহিলাদের প্রবেশাধিকার নিয়ে বিতর্কটি এখন বৃহত্তর আকার নিয়েছে। তিনি টেনে এনেছেন মসজিদে বা দরগায় মহিলাদের প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রের একই কঠোর নিয়মের কথা। অন্য সম্প্রদায়ে বিবাহিত পার্সি মহিলাদের অগ্নিমন্দিরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত মামলা এবং দাউদি বোরা মামলার বিষয়ও একই। এই সব মামলা আদালতে বিচারাধীন। এধরনের ধর্মীয় বিষয় শীর্ষ আদালতের বিচারের আওতায় আসে কি না, তাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। প্রথা ও সাংবিধানিক অধিকার, কোনটা অগ্রাধিকার পাবে বা আদৌ পাবে কি না, তা-ও তুলে আনা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির মতে, বিতর্কে সব পক্ষেরই কথা শোনা উচিত। তাই এই মামলা বৃহত্তর বেঞ্চে পাঠানো হচ্ছে। মোদ্দা কথা সবরীমালার ক্ষেত্রে ‘সর্বসম্মত’ হওয়া যায়নি। শীর্ষ আদালত জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সাংবিধানিক বেঞ্চের সদস্য বিচারপতি আর এফ নরিম্যান ও বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় ভিন্নমত পোষন করেন। তাঁরা ২০১৮ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শীর্ষ আদালতের সবরীমালা সংক্রান্ত রায়কেই বহাল রাখার বিষয়ে মত দেন। দীর্ঘদিনের আন্দোলন ও আইনি লড়াইয়ের পর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বাধীন ৫ সদস্যের বেঞ্চ ৪-১ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় রায় দেয়, লিঙ্গবৈষম্য কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তাই সবরীমালার মন্দির ১০ থেকে ৫০ বছর বয়সি মহিলাদের জন্যও খুলে দেওয়া হবে। সকলেই মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ করতে পারবেন। শীর্ষ আদালত ২৮ সেপ্টেম্বর এই মন্তব্যও করে, ‘বিধিনিষেধকে কখনোই ধর্মীয় প্রথার অংশ হিসেবে তুলে ধরা যায় না।’ এমন প্রথা অস্পৃশ্যতাকে তুলে ধরে বলেও মন্তব্য করে
তৎকালীন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বাধীন ৫ সদস্যের বেঞ্চ।
অন্যদিকে, ৩ বিচারপতি ওই রায় পুনর্বিবেচনার পক্ষে কথা বলেন। শেষ পর্যন্ত বৃহত্তর বেঞ্চে মামলা পাঠানোর ক্ষেত্রে সহমত প্রকাশ করেন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ, বিচারপতি এ এম খানউইলকর এবং ইন্দু মালহোত্রা। এদিন আদালতে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সব পক্ষকেই নতুন করে সুযোগ দেওয়া হল।’ অথচ গত বছর সেপ্টেম্বরে অবসরের আগে তাঁর শেষ রায়ে প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র বলেছিলেন, সবরীমালার মন্দিরকে কেন্দ্র করে লিঙ্গভিত্তিক যে বৈষম্য গড়ে উঠেছে সেটা পুরোপুরি ভিত্তিহীন। সুপ্রিম কোর্ট এই অযৌক্তিকতাকে সমর্থন করে না। আমাদের সংবিধানও এই লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে। আর সেদিন সবরীমালার আয়াপ্পা মন্দিরের নিয়ন্ত্রক ত্রিবাঙ্কুরের দেবাস্বম বোর্ডও শীর্ষ আদালতের রায় মেনে নেয়। তবে বিজেপির দাবি ছিল, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ যেন কেরালা সরকার কার্যকর না করে। গোটা কেরালাজুড়ে তখন হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো ও তাদের রাজনৈতিক দল বিজেপি সবরীমালা মন্দির নিয়ে হুমকি দিচ্ছিল, পরিস্থিতি উত্তপ্ত করছিল, ঠিক তখনই লিঙ্গ বৈষম্যহীন সমানাধিকারের লক্ষ্যে তিরুবনন্তপুরমে কেরালার প্রায় ৫০ লক্ষ মহিলা ১৪ টি জেলায় ৬২৫ কিলোমিটার পথ জুড়ে ইতিহাস নির্মাণ করে গড়ে তুলেছিলেন ‘নারী প্রাচীর’। সম্মিলিত স্বরে তাঁরা বিশ্ববাসীকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ‘আজকের নারী আর অবলা নয়। অসূর্যস্পশ্যা নয়, এমনকী, পুরুষের থেকে কোনও অংশে কম নয়, তাই তাঁকে কোনও অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।’ সেই প্রবল ও স্বতস্ফূর্ত জমায়েত ও প্রতিবাদের পর বিন্দু ও কনকদুর্গা অচলায়তন ভেঙেছেন। তাকে উচ্চে তুলেই শীর্ষ আদালত পাশে দাঁড়াবে বলে মনে করছিল সংবেদনশীল সমাজ। আশা ছিল বিন্দু ও কনকদুর্গাদের। তারপরও কার্যত তখনকার প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রর সাংবিধানিক বেঞ্চের রায়ের পুনর্বিবেচনার রায় বৃহত্তর বেঞ্চে পাঠিয়ে বিষয়টিকে ঝুলিয়েই রাখা হল। কেরালাকে আবার এক অস্থিরতার মধ্যে ফেলা হল, কেননা ১৭ নভেম্বরই আয়াপ্পা মন্দিরের দরজা খোলা হচ্ছে বিশেষ পুজোর জন্য।
দেখা যাচ্ছে, সবরীমালা মন্দিরে সব বয়সী মহিলাদের প্রবেশাধিকারের ব্যাপারেও অযোধ্যার ২.৭৭ একর বিতর্কিত জমির মালিকানা মামলার মতো আইনের ওপরে বৃহদাংশ হিন্দুর আস্থা-ভাবাবেগ-বিশ্বাস-প্রথাকেই জায়গা দিল না শীর্ষ আদালত। আর এবার তা করা হল কোনও সর্বেক্ষণ সংস্থার রায়ে নির্ভর করে নয়, সংবিধানের ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকারের অনুচ্ছেদগুলোর ওপর নির্ভর করে। প্রাধান্য দেওয়া হল ধর্মের স্বাধীনতার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কে।
সব মিলিয়ে জটিলতা চওড়া হল বলেই মনে হয়। সুপ্রিম কোর্টের এবারের অবস্থানে নড়ে গিয়েছে কেরালার বাম সরকারও। আহা! পর পর দুটি রায়ে আইন ও বিশ্বাসের কী অপার মাখামাখি! চুলোয় যাক সভ্যতা ও তাঁর আধুনিকতা, আমরা মধ্যযুগের মতো দেখব শুধুই নারী!

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Comments are closed.