শোনো ডাকে ওই একাদশ শহিদেরা

১৯৬১ সালের ১৯ মে। অসমের বরাক উপত্যকায় অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে আত্মদানের এক ঐতিহাসিক দিন। এই দিন শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে ১১ জন ভাষা সংগ্রামীকে প্রাদেশিক পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। বাংলা ভাষার দাবিতে শহিদ হন কানাইলাল নিয়োগী, চন্ডীচরণ সূত্রধর, হিতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্রকুমার দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকোমল পুরকায়স্থ এবং কমলা ভট্টাচার্য। বাংলা ভাষার দাবিতে বাহান্নর ভাষা আন্দোলন বা একষট্টির ভাষা আন্দোলন—এই দুয়ের প্রেক্ষিত হিসেব করলেই দেখা যায়, ইতিহাস আমাদের একটি ভুলের দিকেই ইঙ্গিত করে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের ঐতিহাসিক ভুলটিই বারবার সামনে চলে আসে এবং এই ভুলের মাশুল বাংলাদেশ যেমন দিয়েছে ২৩ বছরের পাকিস্তানি দুঃশাসন এবং সর্বোপরি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, তেমনি তথাকথিত দেশভাগে ওপারের মানুষকে দিতে হয়েছে বারবার।
১৯৬০ সালের এপ্রিলে, অসম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিতে অসমীয়া ভাষাকে প্রদেশের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার একটি প্রস্তাবের সূচনা হয়। এতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় উত্তেজনা বাড়তে থাকে। অসমীয়া উত্তেজিত জনতা বাঙালি অভিবাসীদের আক্রমণ করে। জুলাই ও সেপ্টেম্বরে সহিংসতা যখন উচ্চ রূপ নেয়, তখন প্রায় ৫০ হাজার বাঙালি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যায়। অন্য ৯০ হাজার বরাক উপত্যকা ও উত্তর-পূর্বের অন্যত্র পালিয়ে যায়। ন্যায়াধীশ গোপাল মেহরোত্রার নেতৃত্বে এক ব্যক্তির একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কামরূপ জেলার গোরেশ্বর অঞ্চলের ২৫টি গ্রামের ৪,০১৯টি কুঁড়েঘর এবং ৫৮টি বাড়ি ধ্বংস ও আক্রমণ করা হয়; এই জেলা ছিল সহিংসতার সবচেয়ে আক্রান্ত এলাকা। নয়জন বাঙালিকে হত্যা করা হয় এবং শতাধিক লোক আহত হয়।

 

১০ অক্টোবর, ১৯৬০ সালের সেই সময়ের অসমের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চলিহা অসমীয়াকে আসামের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। উত্তর করিমগঞ্জ-এর বিধায়ক রণেন্দ্রমোহন দাস এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু ২৪ অক্টোবর প্রস্তাবটি বিধানসভায় গৃহীত হয়।
বরাক উপত্যকার বাঙালীদের ওপরে অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে কাছাড় গণ সংগ্রাম পরিষদ নামক সংগঠনটির জন্ম হয়।
অসম সরকারের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ১৪ এপ্রিল তারিখে শিলচর, করিমগঞ্জ আর হাইলাকান্দির মানুষেরা সংকল্প দিবস পালন করেন । বরাকের জনগণের মধ্যে সজাগতা সৃষ্টি করার জন্য এই পরিষদ ২৪ এপ্রিল একপক্ষ দীর্ঘ একটি পদযাত্রা শুরু করেছিল। ২ মে তে শেষ হওয়া এই পদযাত্রাটিতে অংশ নেওয়া সত্যাগ্রহীরা প্রায় ২০০ মাইল উপত্যকাটির গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার চালিয়েছিলেন। পদযাত্রার শেষে পরিষদের মুখ্যাধিকারী রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেছিলেন, যদি ১৩ এপ্রিল, ১৯৬১ সালের ভিতর বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা না হয়, ১৯ মে তে তাঁরা ব্যাপক হরতাল করবেন। ১২ মে তে অসম রাইফেল, মাদ্রাজ রেজিমেন্ট ও কেন্দ্রীয় সংরক্ষিত পুলিশ বাহিনী শিলচরে ফ্ল্যাগ মার্চ করেছিল। ১৮ মে তে অসম পুলিশ আন্দোলনের তিনজন নেতা নলিনীকান্ত দাস, রথীন্দ্রনাথ সেন ও বিধুভূষণ চৌধুরী (সাপ্তাহিক যুগশক্তির সম্পাদক) কে গ্রেপ্তার করে।
১৯ মে তে শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে হরতাল ও পিকেটিং আরম্ভ হয়। করিমগঞ্জে আন্দোলনকারীরা সরকারি কার্যালয়, রেলওয়ে স্টেশন, কোর্ট ইত্যাদিতে পিকেটিং করেন। শিলচরে তাঁরা রেলওয়ে স্টেশনে সত্যাগ্রহ করেছিলেন। বিকেল ৪টার সময়সূচির ট্রেনটির সময় পার হওয়ার পর হরতাল শেষ করার কথা ছিল। ভোর ৫:৪০ এর ট্রেনটির একটিও টিকিট বিক্রি হয়নি। সকালে হরতাল শান্তিপূর্ণ ভাবে অতিবাহিত হয়েছিল। কিন্তু বিকালে স্টেশনে অসম রাইফেল এসে উপস্থিত হয়।
বিকেল প্রায় ২:৩০র সময় ন’জন সত্যাগ্রহীকে কাটিগোরা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের একটি ট্রাক তারাপুর স্টেশনের (বর্তমানের শিলচর রেলওয়ে স্টেশন) কাছ থেকে পার হয়ে যাচ্ছিল । পিকেটিংকারী সকলে তাদেরকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যেতে দেখে তীব্র প্রতিবাদ করেন। ভয় পেয়ে ট্রাকচালক সহ পুলিশরা বন্দীদের নিয়ে পালিয়ে যায়। এর পর কোনও অশনাক্ত লোক ট্রাকটি জ্বালিয়ে দেয়, যদিও দমকল বাহিনী এসে তৎপরতার সাথে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। তারপর প্রায় ২:৩৫ নাগাদ স্টেশনের সুরক্ষায় থাকা প্যারামিলিটারী বাহিনী আন্দোলনকারীদের বন্দুক ও লাঠি দিয়ে মারতে শুরু করে। এরপর সাত মিনিটের ভিতর তাঁরা ১৭ রাউণ্ড গুলি আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে চালায়। ১২ জন লোকের দেহে গুলি লেগেছিল। তাঁদের মধ্যে ন’জন সেদিনই নিহত হয়েছিলেন; দু’জন পরে মারা যান। ২০ মে তে শিলচরের জনগণ শহিদদের শবদেহ নিয়ে শোকমিছিল করে প্রতিবাদ সাব্যস্ত করেছিলেন।
এই ঘটনার পর অসম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসাবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
আমরা যদি বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে একষট্টির ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে মিলিয়ে পড়ি, তাহলে দেখতে পাই—শাসকগোষ্ঠীর জাত্যাভিমান দু’ ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিলো। ১৯৫২ সালেরে একুশে ফেব্রুয়ারি রাজপথে বাঙালি রক্ত দিয়েছিলো মাতৃভাষার দাবিতে কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সে দাবি মেনে নিলেও বাস্তবায়ন করেনি। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে কেবল এই বাক্যটুকু যোগ করা হয় যে—প্রজাতন্ত্রের ভাষা হইবে বাংলা। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরি করে। অসমেও শাসকগোষ্ঠীর জাত্যাভিমানের কারণে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হয়েছে। অসমের বঙ্গভাষীদের অধিকার হরণের গোপন ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকে। এক অগণতান্ত্রিক নির্দেশনামার মাধ্যমে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অসম কলেজস্তরে শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম হিসেবে অসমীয়া ভাষা প্রচলনের উদ্যোগ নিলে ১৯৭২ সালের ১৯ আগস্ট করিমগঞ্জ শহরে প্রতিবাদে আত্মদান করেন বিজন চক্রবর্তী। রাজ্যের বিদ্যালয় শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষাকে বাতিল করার মধ্যশিক্ষা পর্ষদের দানবীয় নির্দেশনামার বিরোধিতা করতে গিয়ে ১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই করিমগঞ্জেই পুলিশের গুলিতে নিহত হন জগন্ময় দেব ও দিব্যেন্দু দাস।
আজ সাতচল্লিশ বছর পর যখন উনিশে মে’র চেতনা নিয়ে লিখতে বসি, তখন একজন বাঙালি হিসেবে আমার বারবার মনে হয় বাহান্নর ভাষা শহিদদের আত্মদানের কথা। এই ঐতিহাসিক আন্দোলনে যে শহিদগণ আত্মদানের কাব্য রচনা করেছেন, তার সুরের সামনে দাঁড়াই আজকের বাস্তবতায়। আজ কী ঘটছে ভারতে? কী ঘটছে বাংলাদেশে? যে বাঙালি জাতি নিজের মাতৃভাষার অধিকারের জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছে অকাতরে, আজ বাংলাদেশে সে জাতিই ধ্বংস করতে উদ্ধত হয়েছে পাহাড়ের মাতৃভাষা। ক্রমে ক্রমে কমে যাচ্ছে আদিবাসীদের ভাষাগুলো। বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আর, যদি বাংলাদেশের প্রসঙ্গ ধরি, তাহলে চোখের সামনে দেখতে পাই কীভাবে এই দেশেরই নাগরিক পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর ওপর কী নির্মম ভাষা-আধিপত্যবাদ চালানো হচ্ছে।
উনিশে মে’র চেতনা কেবল ক্যালেন্ডারের নয়। উনিশে মে পৃথিবীর সকল ভাষাভাষীদের মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবার গৌরবান্বিত এক মহাপ্রত্যয়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, যে জাতি নিজের ভাষার জন্য জীবন দিতে পারে, সে কখনও অন্য জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষার ওপর অপমান আধিপত্য চালাতে পারে না। উনিশে মে আমাদের এই শিক্ষাই দেয়।
সকল জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষার জয় হোক।

Leave A Reply

Your email address will not be published.