বিরোধী ভোট কাটাকাটিতে মালদহের ২ টি এবং জঙ্গিপুর কেন্দ্রে এগিয়ে তৃণমূল। হাড্ডাহাড্ডি বহরমপুর, আসানসোল, দার্জিলিং জমজমাট

নির্বাচনী রাজনীতি কোনওভাবেই পাটিগণিত নয়, রসায়ন। তাই নির্বাচনের অঙ্কে ২ এর সঙ্গে ২ যোগ করলে অনেক সময় ০ বা ৫ হতে পারে, এমনকী কখনও হতে পারে -৪!
ঠিক যেমনটা হয়েছিল ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে। ২০১৪ সালে বাম এবং কংগ্রেসের মোট প্রাপ্ত ভোটকে যোগ করে অনেকেই তার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোটের। কিন্তু সহজ পাটিগণিতের অঙ্কে সেই হিসেব মেলেনি। এই নির্বাচনী রসায়ন, যা নির্ভর করে নানান বহুমাত্রিক ফ্যাক্টরের ওপর, তার ওপর দাঁড়িয়ে আমরা আগাম কিছু অনুমান করতে পারি মাত্র।
২০১৪ লোকসভায় রাজ্যে তৃণমূল পেয়েছিল ৩৪ টি আসন। যে ৮ টি আসন তৃণমূল হেরেছিল (দার্জিলিং, রায়গঞ্জ, মালদহ উত্তর, মালদহ দক্ষিণ, জঙ্গিপুর, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ, আসানসোল) সেগুলিতে এখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী এবং ২০১৬ সালের পর রাজ্যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেখানে কী সমীকরণ, তা নিয়েই এই লেখা।
জিএনএলএফ এবং বিমল গুরুংয়ের কাছাকাছি আসা গত এক সপ্তাহের মধ্যে দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রের রাজনৈতিক সমীকরণ অনেকটাই পালটে দিয়েছে। তার মধ্যে পাহাড়ের সমন পাঠক এবং সমতলের শঙ্কর মালাকার সিপিএম এবং কংগ্রেস প্রার্থী হওয়ায়, শিলিগুড়িতে ২০১৫ সালের পুরভোটের সময় থেকে বাম-কংগ্রেসের মধ্যে যে একটা ঐক্যের চেহারা তৈরি হয়েছিল, তাও এখন আর নেই। এই কেন্দ্রে লড়াই শুধু চতুর্মুখীই নয়, বিমল গুরুংয়ের পাহাড়ছাড়া হওয়ার ইস্যুতে নেপালি ভোটের আড়াআড়ি বিভাজনের একটা সম্ভাবনাও রয়েছে। সব মিলে তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির এই কেন্দ্রে জোর লড়াই। তবে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাপ্রকৃতি বিজেপিকে সামান্য হলেও এগিয়ে রাখছে।
বাম-কংগ্রেসের আসন সমঝোতার সবচেয়ে বড় সুবিধে তৃণমূল পেতে চলেছে রায়গঞ্জ এবং মুর্শিদাবাদ আসনে। এই দুই আসনেই ২০১৬ সালের নির্বাচনের ফল অনুযায়ী বাম-কংগ্রেসের সম্মিলিত ভোট তৃণমূলের তুলনায় কিছু বেশি হলেও, আসন সমঝোতা ভেস্তে যাওয়ার ফলে ক্লিয়ার অ্যাডভান্টেজ তৃণমূল।
মালদহের দুটি কেন্দ্রে এবার এক পরিবর্তিত এবং নতুন রাজনৈতিক সমীকরণে নির্বাচন হতে চলেছে। এবং এই দুই কেন্দ্রেই কংগ্রেস, সিপিএম এবং বিজেপির মধ্যে ব্যাপক ভোট কাটাকাটির ফলে খুব সম্ভবত সুবিধে পেতে চলেছে তৃণমূল। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটে মালদহ উত্তর কেন্দ্রের ১০ টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে চাঁচোল কংগ্রেসের এবং হবিবপুর ও বামুনগোলা বিজেপির দখলে যায়। বাকি ৭ টিতে জেতে তৃণমূল, যার ফলে এই কেন্দ্রের ৭ টি বিধানসভা আসনের রাজনৈতিক সমীকরণ বিচিত্র চেহারা নিয়েছে। হরিশ্চন্দ্রপুর, চাঁচোল এবং মালতীপুর বিধানসভায় সরাসরি লড়াই হতে চলেছে তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের। অন্যদিকে, রতুয়া, ওল্ড মালদহ এবং হবিবপুর-বামুনগোলা বিধানসভায় লড়াই তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির। আবার গাজোল বিধানসভায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াই তৃণমূল-সিপিএম-বিজেপির মধ্যে। সবকটি বিধানসভায় তৃণমূলের সামগ্রিক উপস্থিতি থাকলেও, বিরোধীরা আলাদা-আলাদা বিধানসভায় শক্তিশালী। কোনও জায়গায় কংগ্রেস প্রথম হলেও, অন্য একটিতে তৃতীয় হয়ে যেতে পারে। একই অবস্থা বিজেপির। যার সুবিধে পাবে তৃণমূল।
একই পরিস্থিতি মালদহ দক্ষিণেও। সেখানকার ৮ টি পঞ্চায়েত সমিতিই তৃণমূলের দখলে। শুধু তাই নয়, মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত সামশেরগঞ্জ এবং ফারাক্কা বিধানসভায় তৃণমূলের সঙ্গে লড়াই কংগ্রেসের। আবার বৈষ্ণবনগর, ইংরেজবাজার বিধানসভায় তৃণমূলের সঙ্গে লড়াই বিজেপির। বৈষ্ণবনগরে বিজেপির বিধায়কও আছে। সুজাপুর এবং মানিকচকে লড়াই তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের। মোথাবাড়ি কেন্দ্রে লড়াই মূলত ত্রিমুখী, তৃণমূল, বিজেপি, কংগ্রেস। সব মিলে এই কেন্দ্রেও কংগ্রেস এবং বিজেপি আলাদা-আলাদা বিধানসভায় শক্তিশালী হওয়ায় এবং বিরোধী ভোট কাটাকাটির সুবিধে পেতে পারে তৃণমূল।
জঙ্গিপুর লোকসভাতেও বাম-কংগ্রেসের ভোট কাটাকাটি, সাম্প্রতিক সময়ে বিজেপির শক্তিবৃদ্ধি এবং পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফল তৃণমূলকে অনেকটা এগিয়ে রাখছে।
দার্জিলিংয়ের পরেই গোটা রাজ্যে তৃণমূলের সবচেয়ে কঠিন লড়াই বহরমপুরে। বা বলা যেতে পারে, জীবনের কঠিনতম লড়াইয়ে নামছেন অধীর রঞ্জন চৌধুরীও। অধীরের তৃণমূল বিরোধী ইমেজ বিরোধী ভোটকে (বামেদের একটা ভোট লোকসভায় তিনি সব সময়ই পেতেন, প্রশ্নটা বিজেপির ভোটের) কতটা তাঁর দিকে এনে দেয়, তার ওপরই নির্ভর করছে প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির জয়-পরাজয়ের অঙ্ক। পাটিগণিতের অঙ্কে কংগ্রেস এই আসনে অনেকটাই এগিয়ে থাকলেও, ভোটের রসায়ন কিন্তু বলছে, তুল্যমূল্য লড়াই হতে চলেছে এই কেন্দ্রে।
আসানসোল কেন্দ্রে ২০১৪ সালে বিজেপির হাওয়া ২০১৬ বিধানসভায় আসন সমঝোতা করে অনেকটাই ঠেকাতে পেরেছিল সিপিএম-কংগ্রেস। এমনকী ২০১৬ বিধানসভায় এই কেন্দ্রের ৭ টি বিধানসভা মিলে বিজেপি যেখানে পেয়েছিল আড়াই লক্ষ ভোট, সেখানে বামেরা একাই পেয়েছিল ৩ লক্ষের বেশি ভোট। এবার বামেরা এই ভোট ধরে রাখতে পারলে তো কথাই নেই, অর্ধেকও পেলে দোলা সেনের হারা আসন পুনরুদ্ধারে সমস্যা হবে না মুনমুন সেনের। কিন্তু গত বছরের রামনবমীর দিন আসানসোলে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের পর অনেক জল গড়িয়েছে দামোদর দিয়ে। সব মিলে রাজনৈতিক মেরুকরণের ছবি রীতিমতো স্পষ্ট এই কেন্দ্রে। আর সেই কারণেই লড়াই কঠিন তৃণমূল-বিজেপি দুই শিবিরের কাছেই।

(নজর রাখুন আগামী পর্বে)

Comments are closed.