তড়িৎ তোপদারকে ছেড়ে অর্জুন ঘনিষ্ঠ! কে মণীশ শুক্লা, যাঁকে খুনের ঘটনায় রাজ্যপাল ধনখড় ডেকে পাঠালেন রাজ্য প্রশাসনকে?

কে খুন করল বারাকপুরের বিজেপি নেতা মণীশ শুক্লাকে? এই প্রশ্ন দিয়েই শুরু করা যেত এই লেখা!

কিন্তু তা করা যাচ্ছে না, কারণ, ৪ অক্টোবর, ভরসন্ধ্যায় টিটাগড়ে মণীশ শুক্লা খুন হওয়ার পর রাত থেকেই যেভাবে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাঁকে নিয়ে ট্যুইট, ভিডিও পোস্ট করেছেন, যেভাবে তাঁর খুনের প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই খোদ রাজ্যপাল ধনখড় রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিব এবং ডিজিকে রাজভবনে ডেকে পাঠিয়েছেন, তাতে কে মণীশ শুক্লা সেই প্রশ্নই মুখ্য হয়ে উঠেছে।

কোচবিহার থেকে ক্যানিং, রাজ্যের মানুষ কীভাবে চেনেন মণীশ শুক্লাকে? এই প্রশ্নই উঠছে, কে এই মণীশ শুক্লা, যাঁর জন্য বাবুল সুপ্রিয় থেকে দিলীপ ঘোষ, স্বপন দাশগুপ্ত থেকে বি এল সন্তোষ, আই টি সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত অমিত মালব্য থেকে কৈলাস বিজয়বর্গীয় সহ বিজেপির একাধিক প্রথম সারির নেতা ট্যুইট করে বা ভিডিও পোস্ট করে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন? রাজ্য প্রশাসনকে তলব করেছেন জগদীপ ধনখড়!

২০০৯ সালের লোকসভা ভোটের দিন সকাল সাড়ে আটটা। বারাকপুরে তখনও কমিশনারেট হয়নি। তখন বারাকপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার প্রভীণ কুমার ত্রিপাঠী, এসডিপিও সুমনজিৎ রায়। ভোট শুরুর সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ খবর পেল টিটাগড়ে কিছু বুথের দিকে যাচ্ছেন মণীশ শুক্লা। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ অফিসাররা কনভয় ছোটালেন সেদিকে। পুলিশ আসছে খবর পেয়েই পালালেন মণীশ। কেন বুথ ছেড়ে পালিয়েছিলেন সেই ভোটে সিপিএম প্রার্থী তড়িৎ তোপদারের হয়ে ‘কাজ’ করার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা মণীশ? তার কারণ জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে মাসখানেক। ভোটের কিছু দিন আগে নানা সূত্র থেকে খবর পেয়ে পুলিশ রেইড করল টিটাগড়ের এক ঘিঞ্জি এলাকার এক গোপন ডেরায়। সেই ডেরার ওপরের টিনের চালা ভেঙে পালিয়ে গেলেন মণীশ শুক্লা। তখন গোটা বারাকপুর জানে সিপিএম সাংসদ তড়িৎ তোপদারের ইলেকশন মেশিনারির অন্যতম স্তম্ভ টিটাগড়ের মণীশ শুক্লা। বারাকপুরের রাজনৈতিক মহলে ২০০৫-০৬ সাল থেকেই মণীশ শুক্লার একমাত্র পরিচয়, তিনি তড়িৎ তোপদারের ডানহাত সঙ্কোচ ঘোষ দস্তিদারের প্রধান লোক। দু’বছরের মধ্যেই মণীশ সিপিএমের অন্দরে আস্থার পাত্র হয়ে ওঠেন। কিন্তু ২০০৯ লোকসভা ভোটের সময় প্রশাসনের ওপর সিপিএমের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই চলে গিয়েছে।

ভোটের কিছু দিন আগে নিজের গোপন ডেরায় পুলিশ রেইডের পরই মণীশ বুঝে গেলেন, আর শেল্টার দিতে পারবে না সিপিএম। সিপিএম তখন নামেই রাজ্যের শাসক, স্থানীয় ক্ষমতা তৃণমূলের হাতে চলে যেতে শুরু করেছে। ২০০৯ লোকসভা ভোটের দিন মণীশ সরকারিভাবে সিপিএমের সঙ্গেই ছিলেন, কিন্তু ভোটে টিটাগড়ের ফলই বলে দিল, তিনি কী ভূমিকা পালন করেছিলেন সেদিন। হেরে গেলেন তড়িৎ তোপদার।

লোকসভার পর অর্জুন সিংহের হাত ধরে তৃণমূলে প্রবেশ করলেন মণীশ শুক্লা। তারপর আবার অর্জুন সিংহেরই হাত ধরে ২০১৯ সালের পর বিজেপিতে।

দশ বছরের মধ্যে বারাকপুরের রাজনীতিতে স্ট্রং-ম্যান হয়ে উঠলেন মণীশ শুক্লা।

পুলিশ জানাচ্ছে, গত ১০-১২ বছরে অন্তত ১৬-১৮ টা মামলা হয়েছে মণীশ শুক্লার বিরুদ্ধে। খুন, খুনের চেষ্টা, অস্ত্র আইন সহ একাধিক মামলা ছিল তাঁর বিরুদ্ধে। থানায় তাঁর বিরুদ্ধে প্রথম মামলা হয়েছিল ২০০৪ সালে। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে মূলত অভিযোগ উঠতে শুরু করে ২০০৯-১০ সাল থেকে। সেই সময় থেকেই টিটাগড়, জগদল সহ বারাকপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায় মণীশ শুক্লার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ উঠতে শুরু করে। মণীশ শুক্লা খুনের ঘটনায় সেই পুরনো সব মামলাই আবার উঠে আসছে পুলিশের নজরে। পুরসভার কাউন্সিলরও হয়েছিলেন মণীশ শুক্লা।

রবিবার সন্ধ্যায় মণীশ শুক্লা খুনের পরই বিক্ষিপ্তভাবে কিছু গণ্ডগোল হয় টিটাগড় সহ বারাকপুরের বিভিন্ন এলাকায়। সোমবার বারাকপুর বনধেরও ডাক দেয় বিজেপি। কিন্তু রাজ্যে বিধানসভা ভোটের সলতে পাকানো শুরু হওয়ার আগেই মণীশ শুক্লার খুন তুলে দিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সিপিএম থেকে মাঝখানে তৃণমূল হয়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া মণীশ শুক্লা নির্বাচনী রাজনীতিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

Comments are closed.