Lockdown: সময় পাই না বলে কেন যে এত অনুযোগ করতাম, কে জানে? জীবন এখন ফার্স্ট গিয়ারে চলছে!

বেশ অনেক বছর আগে শিল্পী নচিকেতা একটা গান লিখেছিলেন, মনে থাকবে আপনাদের….”এই বেশ ভালো আছি” বলে। সেখানে গায়ক লিখেছিলেন…

‘এই বেশ ভাল আছি, কর্ম কাজ নেই, গাড়ি ঘোড়া কিছু নেই,
অফিস কাছারি নেই, হাজিরা কামাই নেই,
শব্দ বা পরিবেশ দূষণ বালাই নেই…
নেই নেই কিছু নেই, তবুও তো কিছু আছে , বলতে যা বাধা নেই…দু’নয়নে ভয় আছে, মনে সংশয় আছে ….’
হুবহু আজকের পরিস্থিতি, তাই না?

অত বছর আগে, আজকের কথা এমন ভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য আরও একবার কুর্ণিশ জানাই তাঁকে।
আসল কথা হল, ওই শেষ লাইনটায়… আমরা সত্যিই বেশ ঘাবড়ে আছি। ঠিক কী ঘটছে, কেন ঘটছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। তার ওপর এমন গৃহবন্দি দশা। বিশ্বাস করুন সেই কলেজে ক্লাস বাঙ্ক, পরবর্তীতে অফিস ফাঁকি, এগুলোর মধ্যে যে রোমাঞ্চ ছিল, তা এক লহমায়, পানসে করে দিল, করোনা নির্বাসন।
এখন এমন অবস্থা হল, যদি মধ্যরাতেও ঘোষণা হয় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার কথা, এতটুকু সময় নষ্ট না করে, আমরা ছুটব যার যার অফিসে।
কয়েকদিনেই বেশ হাপিয়ে উঠেছি।
মিডিয়াতে দীর্ঘ বছর কর্মরত অবস্থাতেও অকারণে ছুটি নেওয়ায় খুব একটা সুনাম ছিল না আমার। আর এখন তো, entrepreneur হিসেবে কাজ শুরু করার পর থেকে উইকলি অফ শব্দটিও প্রায় ভুলতে বসেছি। এমন সময়ে, আগন্তুক করোনা, এবং তার সাথে নির্বাসন। নিজের কথা, পরিবারের কথা, দেশের কথা, দশের কথা ভেবে দাঁতে দাঁত চেপে #stayathome পালন করছি আমরা।
প্রথম কিছুদিন বেশ উৎসাহ চোখে পড়েছিল, কী করব, কী করব না, সরকার কীভাবে সামাল দেবেন, ঠিক কতদিন ঘরবন্দি থাকা উচিত, ইত্যাদি সমস্ত বিষয়ে সে কী উৎসাহ আমাদের। ইনফ্যাক্ট একদিনের জনতা কারফিউ পালন করে দেশাত্মবোধে টগবগ করে ফুটছি আমরা। অবশেষে যখন ২১ দিনের জন্য ঘরবন্দি হলাম এবং প্রাথমিক উত্তেজনা কাটিয়ে উঠলাম, ততদিনে যা হওয়ার হয়ে গেছে। অর্থাৎ, বাড়ি ঘরদোর স্যানিটাইজ করা, রেশন তুলে রাখা থেকে শুরু করে রান্নায় হাতযশ দেখানো। এমনকী পছন্দের ওয়েব সিরিজ যেগুলো দেখা বাকি ছিল, সবই প্রায় দেখা শেষ।
এবার সেই লাখ টাকার প্রশ্ন, সময় কাটবে কীভাবে? আসলে এতদিন ধরে এটাই শিখে এসেছি, ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যেও কীভাবে নিজের জন্য বা পরিবারের জন্য সময় বের করতে হয় । কিন্তু এখন তো ঠিক উল্টো পরিস্থিতি, কোনও ব্যস্ততা তো নেই-ই, প্রচুর সময়, তুলনায় কাজ কম। আসলে আমরা যাঁরা ওয়ার্কিং ওম্যান, (কেন যে এই নামকরণ অবশ্য জানি না। কারণ ঘরে হোক বা বাইরে আমরা সবসময়ই ওয়ার্কিং বলে আমার মনে হয়।) তাঁরা অল্প সময়ে বাড়ির কাজ সেরে ফেলার ক্ষমতা রাখি। অতএব বাড়িতেই সকাল থেকে রাত, পরিবারের সাথেই সারাক্ষণ। ভালো মন্দ সবই বড্ড চোখে পড়ছে। আগে যে বিষয়ে পাত্তাই দিতাম না, তাই আজ যেন বিরক্তির কারণ হয়ে উঠছে। পিএনপিসিতে অভ্যস্ত আমরা বাঙালি, রাতারাতি এত ভালো হয়ে গেলাম যে, অত্যন্ত বেসুরো গানের পোস্টেও বাহবা দিয়ে চলেছি। দু’চোখে যাঁকে দেখতে পারি না, তাঁর সাথেক চ্যাট করছি, ভিডিও কল করছি।
যাই হোক, অবশেষে সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট এর তত্ব মাথায় রেখে, যাবতীয় উত্তেজনা প্রশমিত করে শান্ত হয়ে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। অনেকটা রাস্তার স্পিড ব্রেকারের মতো, জীবনের গাড়ি এখন ফার্স্ট গিয়ারে চলছে।
জান হ্যায় তো জাহান হ্যায়, এই কথাটি হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছি। তার সাথে এটাও বুঝেছি কতটা অসামাজিক হয়ে গিয়েছিলাম, শিকড়ের মাটি যে আলগা হচ্ছিল সেটা বুঝতে পারিনি।
করোনা যে কত কিছু করিয়ে নিল, আর বুঝিয়ে দিল আমাদের, তা শুধু আমরাই জানি।
সকালের চা, তারপর খানিক এক্সারসাইজ (না করলে জামাকাপড় আঁটবে না আর, তাই), জল খাবার, লাঞ্চ, ডিনারের বন্দোবস্ত, বাড়ি পরিষ্কার রাখা, সোশ্যাল মিডিয়াতে লাইক, কমেন্ট দেওয়া, শর্ট ফিল্ম দেখা, গান শোনা, কখনও শখনও লেখালেখি, আগামীর কাজের পরিকল্পনা, বাড়ির সকলের সাথে আড্ডা, মায়ের সাথে নিয়মিত ভিডিও কল (যেখানে অনেক সময়, ভালোভাবে কথা বলার সুযোগ পেতাম না), এত কিছুর পরও তো দিব্যি সময় পাচ্ছি আপনাদের সাথে কথা বলার। কী জন্য এতো অনুযোগ করতাম, সময় পাই না বলে….. কে জানে।
যাই হোক এখন একমাত্র প্রার্থনা সকলে সুস্থ থাকুন, আগামী দিন ভালো হোক সকলের। স্বাভাবিক জীবন যাপনে ফিরতে পারলে বাঁচি এখন। বেশি দিন, এতো ভালো হয়ে থাকাটা ঠিক ধাঁতে সয় না মশাই। উড়ুউড়ু করবেন না, আরও কিছুদিন এই ভাবেই চলুন।
আশা করি তাড়াতাড়ি দেখা হবে সকলের সাথে। ও, আর একটা কথা, পিএনপিসি’টা প্লিজ ছাড়বেন না, ওটাতে কী ভালো যে সময় কাটে, আর ক্রিয়েটিভিটি বিচ্ছুরণ যা ঘটে, সেটা জুন আন্টি, আর শ্রীময়ীর চেয়ে কোনও অংশে কম রোমহর্ষক নয়। ভালো থাকবেন।

Comments are closed.