Lockdown: এত বছরের সাংবাদিকতা জীবনে মানুষের মধ্যে এই ভয়, সন্দেহ কখনও দেখিনি! সবাই ভাবছি, অন্যের শরীরে করোনা নেই তো

অনেক বছর হল সাংবাদিকতা পেশায় আছি। বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই পেশার খাতিরে অনেক দুঃখজনক ঘটনা কভার করতে হয়েছে। ‘মাস ট্র্যাজেডি’ বললে সাম্প্রতিক সময়ে নেপালের ভূমিকম্পের কথা বলব। সেখানে খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে মানুষের মৃত্যুমিছিল দেখেছি। স্বজন বিয়োগের আর্তনাদের সাক্ষী হয়েছি। দেখেছি, বাড়ি-ঘর ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়ার পর আশ্রয়হীন মানুষের বিপর্যস্ত অবস্থা। কলকাতায় নির্মীয়মাণ পোস্তা ব্রিজ ভেঙে পড়ে ২০-২২ জনের মৃত্যু দেখে শহরবাসীর আতঙ্কগ্রস্ত মুখ দেখেছি। কিন্তু কোনওবার যে অনুভূতির সম্মুখীন হইনি, তা হল ভয় ও সন্দেহ।

নেপালের ভূমিকম্পে স্বজন ও সম্পত্তি হারানো মানুষ জেনে গিয়েছেন, তাঁদের যা হারানোর হারিয়ে গিয়েছে। নতুন করে হারানোর কিছু নেই। পোস্তা কিংবা মাঝেরহাট ব্রিজ ভেঙে পড়ায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছিল, চিন্তা ছিল রাস্তায় বেরিয়ে নিজে একটা দুর্ঘটনার শিকার হব না তো। কিন্তু প্যানডেমিক করোনাভাইরাসের জেরে মানুষের মধ্যে যে ভয় ও সন্দেহের তীব্র বহিঃপ্রকাশ ঘটছে, তা আগে দেখিনি।

করোনাভাইরাস, ভয় ও সন্দেহ 

গত দু’সপ্তাহ ধরে করোনাভাইরাস নিয়ে খবর করতে বেরিয়ে মানুষের চোখে-মুখে, চেহারায় একটি কমন অনুভূতি দেখেছি, তা হল ভয়, সন্দেহ এবং অনিশ্চয়তা। সেই সন্দেহ কোনও নির্দিষ্ট শ্রেণির প্রতি নয়। যখন আমি কারও সামনে যাচ্ছি, আমার প্রতি তাঁর চোখে সন্দেহ দেখছি। আবার ওনার প্রতি ঠিক একই অনুভূতি আমার মধ্যেও রয়েছে। লকডাউনে বন্দি রাস্তায় কর্মরত পুলিশ, পেপারওয়ালা, প্রতিদিন বাড়িতে যে দুধওয়ালা দুধ দিতে আসেন, বাজারের সবজি বিক্রেতা, সবার প্রতি সবার এক সন্দেহ ও ভয় কাজ করছে, ওঁর শরীরে করোনা নেই তো?

এই সন্দেহ আর ভয়ের প্রকাশ আমাদের আবেগ, অনুভূতিকে আঘাত করছে। আমি হয়ত চাইছি না যাঁকে নিয়ে ‘স্টোরি’ করতে গিয়েছি, তাঁকে নিয়ে আমার মধ্যে কোনও ভয় ও সন্দেহ কাজ করুক। উলটোদিকের মানুষটিও হয়তো সেটাই ভাবছেন। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে প্রতি মুহূর্তে আমরা একে অন্যকে সন্দেহ করছি ভয় থেকে, আশঙ্কা থেকে। এমনই প্রভাব এই কোভিড-১৯ -এর। এই ‘ভয়’ ও ‘সন্দেহের’ যে শুধু আমরা ভুক্তভোগী তাই নয়, জেনে কিংবা অজান্তে এই ভয় ও সন্দেহের জোগান দিচ্ছি আমরাই। দীর্ঘ পেশাগত জীবনে এই অভিজ্ঞতা কখনও আগে হয়নি।
করোনা নিয়ে খবর করতে গিয়ে মানুষকে সজাগ করার জন্য যখন সোশ্যাল ডিসট্যান্সিংয়ের কথা বলছি, কোনও না কোনওভাবে আমিও আসলে বলছি অন্যজনকে সন্দেহ করুন, ভয় করুন। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই তেতো সত্যি কথা। কিন্তু মানুষ নিরুপায়। করোনা নামের মারণ ভাইরাসের গ্রাস থেকে যতদিন না আমরা বেরিয়ে আসব, এই ভয় ও সন্দেহের বীজ সবার মধ্যে থেকে যাবে।
এসব জেনেও যখন অন্যদিকের পুলিশ কর্মী বা কোনও সাধারণ মানুষ আমার সঙ্গে কথা বলার সময় সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং বজায় রাখছেন, আমার মধ্যে অজান্তে প্রশ্ন আসছে, আমি কি অচ্ছুত? পাশের পুলিশ কর্মী কিন্তু বলছেন না, আমি তোমাকে ঘৃণা করি, কিন্তু এই দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে কোথাও গিয়ে এই প্রশ্নটা বারবার বুকে ধাক্কা দিচ্ছে। অথচ এখনকার পরিস্থিতিতে আমি যখন স্টোরি করতে যাচ্ছি, নিজেও দূরত্ব বজায় রাখছি। আগের মতো উত্তরদাতার একদম কাছে গিয়ে মাইক ধরছি না।
বাস্তবতা মেনে নেওয়া হল দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা। জরুরি পরিষেবার মধ্যে পড়ে মিডিয়া। সাংবাদিক মাত্রেই যে অ্যাকসেস পায়, সে জন্য তাঁর মধ্যে চোরা অহং বোধও আছে। আমি নেতা-মন্ত্রী, আমলা, পুলিশের বড় কর্তা থেকে সাধারণ মানুষ, সবার সামনে যাওয়ার, কাছে চলে যাওয়ার সুযোগ পাই। একজন সাংবাদিকের মধ্যে যেন দৃঢ় আত্মবিশ্বাস আছে, আমাকে কে আটকাবে, কই আটকে দেখাক দেখি! আমার মনে হয় এই প্রথমবার, একটা ভাইরাস সংক্রমণের ভয়, আতঙ্ক সাংবাদিকের সেই আত্মবিশ্বাসকে টলিয়ে দিয়েছে। সাংবাদিক হলেও একজন রক্তমাংস দেহের যে ভয় রয়েছে। নিজের প্রাণ, সেখান থেকে কাছের মানুষজনকে সংক্রামিত করে দেওয়ার ভয়। তাছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে এই জরুরি পরিষেবার মধ্যে মিডিয়ার চেয়েও অনেক বড় এবং প্রয়োজনীয় ভূমিকা নিয়েছেন হাজার হাজার চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্য কর্মী। নিজেদের জীবন বিপন্ন করে তাঁরা যেভাবে কাজ করে চলেছেন, তাঁদের সঙ্গে যদি নিজেদের তুল্যমূল্য বিচার করতে বসি, ধারেকাছেও নেই মিডিয়া। যে কোনও পরিস্থিতিতে মিডিয়া অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু বর্তমানে চিকিৎসক, স্বাস্থ্য কর্মীদের গুরুত্ব ঢের বেশি।

জনতা কার্ফু থেকে লকডাউন পিরিয়ডের প্রথম দিকে খবরের সন্ধানে বেরিয়ে বাজারে বাজারে কাতারে কাতারে মানুষের ভিড় দেখে মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়েছি। তাঁদের চোখে, চেহারায় ভয়, সন্দেহ রয়েছে ঠিকই, তবুও সে সব উপেক্ষা করে তাঁরা রসদ সংগ্রহে বেরিয়ে পড়েছে। দীর্ঘ লাইন দিয়ে চাল-ডাল, সবজি কিনছেন। প্রশ্ন করেছিলাম, যখন বারবার সোশ্যাল ডিসট্যান্সিংয়েরর কথা বলা হচ্ছে, তখন কেন এভাবে ভিড় বাড়াচ্ছেন? পরের দিনের জন্য কি অপেক্ষা করা যেত না? একজনের উত্তরে চমকে গিয়েছিলাম। তিনি জানান, পেটে খিদে থাকলে লজিক মাথায় ঢোকে না। মারণ ভাইরাস রোধে সব কিছু করতে রাজি আছি। কিন্তু না খেয়ে থাকতে রাজি নই। ঠিক একই রকমের অভিজ্ঞতা হয়েছে একটি গ্যাস ডিলারের দোকানের বাইরে। সেখানে পুরুষ, মহিলা নির্বিশেষে কেউ মোটর সাইকেল, কেউ রিকশ, আবার কেউ স্রেফ হেঁটেই খালি সিলিন্ডার নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন লম্বা লাইনে। কিন্তু ডেলিভারি বয় তো রয়েছেন, একদিন অপেক্ষা করলে কী এসে যেত? কেন নিজেরাই ছুটে আসছেন? এখানেও সেই ভয় আর সন্দেহ কাজ করছে। তার সঙ্গে বাস্তব ভাবনা। তাঁদের আশঙ্কা, যে গ্যাস ডেলিভারি বয় বাড়ি বাড়ি সিলিন্ডার পৌঁছে দিচ্ছেন, তাঁর শরীরে করোনা নেই তো? এঁদের মধ্যে অনেকেই যে আবার ভিন রাজ্যের বাসিন্দা। এই ভাবনা আর রান্নাঘর চালিয়ে রাখার জ্বালানির জন্যই সেই ভিড়। আসলে সবার আগে ক্ষুন্নিবৃত্তি।

করোনার আতঙ্কে লকডাউন শহরের ফাঁকা রাস্তাঘাট দেখে চমকে গিয়েছি। অনেক বনধ্ দেখেছি, কিন্তু এমন খাঁ খাঁ শূন্যতা আগে দেখিনি। আচমকা কেউ যেন পজ বাটন টিপে দিয়েছে এ শহরকে। কারও তাড়া নেই। রাস্তায় পুলিশ কর্মী আর কয়েকটা সরকারি বাস, তাও আবার ফাঁকা, এটাই এ ক’দিনের কলকাতার পরিচিত ছবি হয়ে উঠেছে। প্রথমদিকে কিছু মানুষ হয়তো লকডাউন ভেঙে রাস্তায় এসে পুলিশের বকুনি খেয়ে আবার ঘরে ঢুকেছেন, কিন্তু শহরের সামগ্রিক চিত্রের ক’দিনে আমূল বদল হয়েছে। প্রতিটি রাস্তা, মোড়, গলিতে ঘুরে শুধু একটা দ্বন্দ্বের কথা চিন্তা করেছি, জীবন, জীবনধারা ও বাস্তবতা। জীবনের তাগিদে হুট করে মানুষ যেন একটা অন্য জীবনধারায় নিজেকে অভ্যস্ত করে নিয়েছে। বাধ্য হয়ে বাস্তবতা মেনে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে সচেষ্ট সবাই।

এই ক’দিন যতবার কাজে বেরিয়েছি, বাড়ির লোকের ফোনে বাধা পেয়েছি। তাঁদের উদ্বেগ মোটেই অমূলক নয়, কিন্তু নিজেকে প্রশ্ন করে উত্তর পেয়েছি এটাই আমার কাজ। জরুরি পরিষেবার মধ্যে যখন আমাকে গণ্য করা হয়েছে, কী করে নিজের কর্তব্য, দায়িত্ব থেকে সরে আসব? যে মানুষগুলো খাবার পাচ্ছে না, বিভিন্ন বিপদ আপদের সম্মুখীন হয়েছে, রাত ১০ টার পরও যারা দোকানের বাইরে লম্বা লাইন দিয়ে খাবার জোগাড় করছে, তাদের কথা তুলে ধরাই তো আমার কাজ। এই অতিমারির সময় যখন গুজব, ভুয়ো তথ্যে মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছেন, তখন সঠিক খবর সবার কাছে পৌঁছে দেওয়াটাই তো আমার পেশা।
কিন্তু পেশার খাতিরে লকডাউনের শহরে বেরিয়ে আমিও কি অসুবিধা, বাধার মুখে পড়িনি? অবশ্যই পড়েছি। এখন সবাই বেশি করে পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর দিচ্ছেন। কিন্তু আমার মতো পুরুষ, মহিলা নির্বিশেষ যে সাংবাদিক বন্ধুরা বাইরে বেরচ্ছেন, তাঁরা প্রাকৃতিক কাজ কোথায় করবেন, তা নিয়ে বড় সমস্যায় পড়ছেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাইরে থাকতে হয় আমাদের। কিন্তু অফিস থেকে সুলভ শৌচাগার বন্ধ। কারও বাড়িতে যাওয়ার উপায় নেই এখন। এই অবস্থায় নিজেকে একটা রুটিন করে নিতে হয়েছে, যার জন্য কোনও সময় বা প্রস্তুতি পাওয়া যায়নি। এখন প্রতিদিন কাজে বেরিয়ে কিছুক্ষণ পর আবার নিজের ঘরে ফিরছি, খাওয়া দাওয়া, স্নান ইত্যাদি সেরে আবার খবরের সন্ধানে বেরোচ্ছি, ফের বাড়ি ফিরছি। কাজের জন্য যে গাড়িতে যেতাম, তার এজেন্সি বলে দিয়েছে এখন গাড়ি পাওয়া যাবে না। কোনও ড্রাইভার এখন বেরোতে রাজি নন। এই অবস্থায় নিজে গাড়ি নিয়ে বেরোচ্ছি খবর সংগ্রহে। চাকরি সূত্রে আমি বাড়ি ছেড়ে একা এই শহরে থাকি। আমার রান্নার জন্য একজন দিদি আছেন। আর একজন ঘরদোর পরিষ্কার করে দিয়ে যান। এ ক’দিনে তাঁদের অনুপস্থিতে রান্না করা থেকে বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে উপলব্ধি করলাম, আমার জীবনে এঁদের অবদান কতটা।

কাজে বেরিয়ে ঘুরছি শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। লকডাউনের সময় বাজারের ভিড়ে যেমন শিক্ষিত মানুষ রয়েছেন, তেমনি নিরক্ষর মানুষও আছেন। অনেক দিন পর সুযোগ পাচ্ছি শুধু মানুষের জন্য মানুষের খবর তৈরি করার। দিনের পর দিন ক্ষমতার করিডোরে ঘুরতে হয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী কী বললেন, কোন নেতা কী বললেন, দেশ, রাজ্যের কোথায় কী ঘটল তার খবর সংগ্রহের জন্য। কিন্তু বহুদিন পর সুযোগ পেলাম সাধারণ মানুষ কী বলছে, তারা কী ভাবছে, তারা কোন অসুবিধার মুখোমুখি হচ্ছে, স্রেফ তাদের জন্য তাদেরকে নিয়ে খবর করার। আজ যদি সাংবাদিকরা চুপ করে বসে থাকে, কাল প্রশ্ন উঠবে, আমরা কেন চুপ ছিলাম যখন কোনও সাধারণ গৃহস্থ চেয়েছিলেন আমরা তাঁর কণ্ঠ হয়ে উঠি?

মানুষে মানুষে কাছে আসা 

কয়েক দিন আগে খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে এক মসজিদ থেকে ঘোষণা শুনলাম, ‘ইনসান কে সেহাদ সাবসে বড়া ইবাদত’, অর্থাৎ, মানুষের শরীর তার সবচেয়ে বড় পুজো। মসজিদ, মন্দির, গুরুদুয়ারা, সব সোশ্যাল ডিসটান্সিংয়ের জন্য বন্ধ রাখা হচ্ছে। মানুষকে যেন বোঝানোর চেষ্টা চলছে, তোমরা বোঝ এই শরীরকে কষ্ট দিয়ে প্রার্থনার মাধ্যমে আল্লা, ভগবান করে লাভ হয় না। যেন উপরওয়ালা আবার একবার সুযোগ করে দিচ্ছে নিজেদের ভুল সংশোধন কর, আরও ভালো মানুষ হও, পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হও।

গাড়ি করে ফেরার পথে দু’দিন আগে একজন আমার কাছে লিফট চাইলেন। আমি জানতে চাই, কোথায় যাবেন? তিনি বললেন, শিয়ালদহ। আমি জানাই, আমি তো ওদিকে যাচ্ছি না। ওই ব্যক্তির অনুরোধ, যেদিকেই যান, একটু এগিয়ে দিলে হবে। বাকিটা তিনি হেঁটে চলে যাবেন। কতটা বিপদে পড়লে মানুষ এতটা ঝুঁকি নিয়ে নিজের শরীরকে এতটা কষ্ট দিতে রাজি হয়! আমি তাঁকে বিশ্বাস করব না?
এই ক’দিনে গাড়িটাকে একটা আস্ত সংসার করে নিয়েছি। খাবার, জল, স্যানিটাইজার, জামাকাপড় থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সব জিনিস রেখেছি। যদিও স্যানিটাইজারের গন্ধটা আমার মোটেই ভালো লাগে না। তবু নিরাপত্তার জন্য রাখতেই হবে। তাছাড়া কাজের প্রয়োজনে যে মানুষগুলোর কাছে যাচ্ছি, তাঁদেরও দিচ্ছি।
অনেক সহকর্মীকে আমি বলতে শুনেছি, রিপোর্টার হতে গেলে আবেগকে বশে রাখতে হবে। আবেগের কোনও জায়গা নেই। যদিও আমার মত ভিন্ন। কারণ, একটা রিপোর্ট শুধু আমার কাছে খবর সংগ্রহ নয়, আমি যদি মানুষের সমস্যার কথা উপলব্ধি করতে না পারি, বিচার বিশ্লেষণ করতে না পারি, ভুক্তভোগীর পাশে দাঁড়াতে না পারি, তাহলে সেই খবর আমার কাছে অন্তত অর্থহীন।

এই লকডাউনের মধ্যে রাতের শহরে দুই প্রৌঢ়াকে বসে থাকতে দেখে তাঁদের কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম, বাড়ি যাননি কেন। তাঁরা জানালেন, রাস্তাতেই বাস, ভিক্ষা করে খাবার জোটে। কিন্তু লকডাউন বন্দি শহরের রাস্তায় কেউ বেরোয়নি। তাই দানাপানিও জোটেনি। কাছে থাকা কয়েক প্যাকেট বিস্কুট এগিয়ে দিয়েছিলাম, আশ্বস্ত করেছিলাম, পরের দিন খাবার নিয়ে আসব। যদিও সরকারের তরফে পরে ঘোষণা করা হয়েছে বলে জানতে পারি, এমন গৃহহীন মানুষদের জন্য কিছুদিন রাতে থাকার এবং খাবারের বন্দোবস্ত করা হবে। শুনে আশ্বস্ত হয়েছিলাম। একটি ভাইরাস আজ বড়লোক, গরিব, হিন্দু, মুসলমান সবাইকে একলাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। যত টাকাই পকেটে থাকুক, কোনও বড়লোক পয়সা দিয়ে করোনার ওষুধ কিনতে পারবে না। আর একজন গরিব মানুষ সরকার, সমাজের কাছে আজ মহা মূল্যবান। কারণ তাঁর শরীরেও যদি এই মারণ ভাইরাসের সংক্রমণ হয় সেখান থেকেও ছড়িয়ে পড়তে পারে করোনা। তাই একজন গরিব মানুষের গুরুত্বও সমাজ ও সরকারের কাছে হঠাৎ বেড়ে গিয়েছে। গত শনিবার এমজি রোডের কাছে দেখলাম কয়েকজন খিচুড়ি বিলি করছেন। তাঁরা জানালেন, কোনও দল বা সংগঠন নয়, নিজেদের টাকা থেকেই নিরন্নদের এই সাহায্য করছেন। এখন খাবারই ভগবান, যার কোনও জাতি-ধর্ম-বর্ণ নেই। কলকাতার বুকে হাতে টানা রিকশ চালকরা আজ বাজার চলতি প্রৌঢ়-প্রৌঢ়াদের আসা যাওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন। এঁদের বেশিরভাগই কিন্তু ভিন রাজ্যের বসিন্দা। এঁরা না থাকলে আজ বাজারের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে বাজার করা, তারপর অটো না পেয়ে বাধ্য হয়ে হেঁটে ঘরে ফিরতে হত প্রচুর বৃদ্ধ, প্রৌঢ়কে। এই হাতে টানা রিকশ চালকরা অতিমারির সময় পরিষেবা দিয়ে চলেছেন। এই ক’দিনে পরিবেশ বদলে গিয়েছে। গত সাত বছরে এর আগে কবে আমার অফিস পাড়ায় কোকিলের ডাক শুনেছি, মনে করতে পারছি না। দীর্ঘ লকডাউনে দেশের অর্থনীতি নিয়ে অবশ্যই চিন্তা বাড়ছে। অফিস, কল-কারখানা বন্ধ। ঘরে বসে থাকাটা তো কোনও সমাধানের পথ নয়। কিন্তু করোনাও ইতিহাস হবে। একদিন এর প্রভাব থামবে। কিন্তু মানুষ যেন পরিবেশের কথাটাও ভাবে। ঠিক এইভাবে নিজেদের পাশে দাঁড়ায়। এই অতিমারি করোনাভাইরাস যেন মানুষে মানুষে সেই কাছে আসার সুযোগ করে দিয়েছে, নতুন করে আরও একবার ভাববার সুযোগ দিয়েছে।

আজকাল কাজ থেকে ফেরার সময় আর গান শুনতে ভালো লাগে না। ভালো লাগে না খবর দেখতে। আজকাল কবিতা পড়তে ও শুনতে বেশি ভালো লাগে। গত কয়েক দিন ধরে অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্তের ‘ছন্নছাড়া’ কবিতার কয়েকটা লাইন যেন এই সময়কে ঘিরে রয়েছে বলে মনে হয়।

“প্রাণ আছে, প্রাণ আছে– শুধু প্রাণই আশ্চর্য সম্পদ
এক ক্ষয়হীন আশা
এক মৃত্যুহীন মর্যাদা”
এই লাইনগুলি বারবার মনে পড়ে ভিড় শূন্য কলকাতার বুক চিরে বাড়ি ফেরার সময়।

 

(তমাল সাহা কলকাতায় টাইমস নাউ চ্যানেলের ব্যুরো চিফ এবং স্পেশাল করেসপনডেন্ট)

Comments are closed.