শারীরিক ও আর্থিক প্রতিবন্ধকতাকে হারিয়ে রিমোর সাত সমুদ্র জয়ের স্বপ্ন

জন্মের মাস কয়েক পরেই পোলিও আক্রান্ত হয় ছেলেটি। যখন তিন বছর বয়স, তখন হাঁটাচলাই বন্ধ হতে বসেছিল। তাঁকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসক বলেন, পোলিওতে একটি পা প্রায় অক্ষম হয়ে যেতে বসেছে। উপায় একটাই। সাঁতার এবং সাইকেল চালানো অনুশীলন করা। তাতে পায়ের ব্যায়াম হবে। যে চিকিৎসক বলেছিলেন, তিনিও জানতেন না, তাঁর এই পরামর্শ জীবনটাই বদলে দেবে রিমো সাহার। প্রতিবন্ধকতা নিয়েও দিনের পর দিন সে গর্বিত করবে গোটা দেশকে। তেরঙা উড়িয়ে আসবে বিলেতের মাটিতে।

সালকিয়া নন্দী বাগানের রিমো সাহা। প্রতিবন্ধী এই সাঁতারু ইতিমধ্যেই ইংলিশ চ্যানেল এবং ক্যাটালিনা চ্যানেল জয় করেছেন। তবে নিজেকে কোনওভাবেই প্রতিবন্ধী ভাবতে নারাজ তিনি। ২০০৪ সাল থেকেই রাজ্য এবং জাতীয় স্তরের বিভিন্ন সাঁতার প্রতিযোগিতায় পদক জেতা শুরু রিমোর। তারপর ধীরে ধীরে আরো বড় স্বপ্ন দেখা। প্রতিবন্ধকতাকে হেলায় উড়িয়ে ইংলিশ চ্যানেল জয়ের লড়াই শুরু করেন রিমো। দীর্ঘ ৭ মাস পুনেতে রোহন মোরের কাছে প্রশিক্ষণ নেন। ২০১৮ সালের জুনে ইংলিশ চ্যানেল পার করেছেন। কতটা কঠিন ছিল সেই লড়াই? রিমো বলছিলেন, ‘জলে নামলে আমার ডান পা কাজ করে না। পুরোটাই বা’পা এবং দুটো হাতের মাধ্যমে করতে হয়। একটা পায়ের উপর অতিরিক্ত জোর দেওয়ার ফলে সেখানেও ক্র্যাম্প ধরার ভয় থাকে। আর একবার ক্র্যাম্প ধরলে জল থেকে উঠে যেতে হবে। আর সেখানেই সব স্বপ্ন শেষ। খালি হাতে ফিরে আসতে হবে দেশে। তাই বেশ কিছুক্ষণ শুধু দু হাতের উপর ভরসা করেই আমাকে এগোতে হয়। ইংলিশ চ্যানেলের জল ছিল প্রচণ্ড ঠান্ডা। ১২ ঘন্টা ২৬ মিনিটে আমি ইংলিশ চ্যানেল জয় করি।’

তারপর ক্যাটালিনা চ্যানেল জয় করেছেন রিমো। তাও পরপর দুবার। মাত্র ৩ দিনে। একবার একা, আর একবার দলের সঙ্গে। এখানে ছিল অন্য সমস্যা। হাঙ্গরের ভয়। তাই রাতে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পেরিয়ে যেতে হয়েছে হাঙ্গরের পাড়া। এই সমুদ্রে প্রচুর ডলফিন থাকলেও, তারা কোন সমস্যার সৃষ্টি করে না বলেই জানিয়েছেন রিমো।

সাত সমুদ্রের মধ্যে দুটি লক্ষ্য পূরণ হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। এখন লক্ষ্য নর্থ চ্যানেল জয়। সেখানে সব থেকে বড় প্রতিবন্ধকতা বরফ গলা ঠান্ডা জল। ইতিমধ্যেই অনুশীলন শুরু করে দিয়েছেন তার জন্য। গোটা শীতকাল কলকাতাতে অনুশীলন করবেন। মার্চে অনুশীলন করতে চলে যাবেন নৈনিতাল। ঠান্ডার সঙ্গেও এখানে ভয় থাকবে জেলিফিশের। একবার জেলিফিশ আক্রমণ করলে সমুদ্র থেকে উঠে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না।

এই সব প্রতিবন্ধকতা তো আছেই। তবে নিজের শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে যেমন ফুৎকারে উড়িয়েছেন, তুমি এগুলোকেও উড়িয়ে দেন তিনি। সব বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যান একের পর এক সমুদ্র। কিন্তু বাস্তব যে বড় কঠিন। এত প্রতিবন্ধকতা সঙ্গে লড়াই করার পর, রিমোকে এখন লড়তে হয় আর্থিক প্রতিবন্ধকতার সঙ্গেও। ২০২০ সালের জুলাই মাসে নর্থ চ্যানেল অভিযানে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন ৭-৮ লক্ষ টাকা। বিপুল পরিমাণ টাকা কোথা থেকে জোগাড় হবে, জানা নেই রিমোর। রাজ্য তথা দেশের মুখ বারবার উজ্জ্বল করেও এখনও কোনো চাকরি পাননি। কেউ স্পনসর করতে এগিয়ে আসেনি। তবু রিমোর জেদ, তাঁর স্বপ্ন পূরণে বাধা হতে পারবে না কোনও প্রতিবন্ধকতা। তিনি এগোবেন। জীবন সমুদ্রের উথাল-পাতাল ঢেউ এর মধ্যে দিয়েই তিনি সাঁতরে যাবেন সাফল্যের চূড়োয়।

Comments are closed.