ফরাসি ছাত্র আন্দোলনের ৫০ বছর: ছাত্র রাজনীতি বনাম রাষ্ট্র ক্ষমতার লড়াই।

যে কোনও রাজনৈতিক পরিসর বৃহত্তর রাজনীতির একটা প্রতিফলন মাত্র, ছাত্র রাজনীতি এর ব্যতিক্রম নয়। তাই ছাত্র রাজনীতির কথা শুধুমাত্র ক্যাম্পাসের গণ্ডির ভিতরকার সমস্যা-সমাধানের সমীকরণে সীমিত থাকে না, তা হয়ে ওঠে অধিকারের লড়াই, বাঁচা-মরার লড়াই। ক্ষমতার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যখনই ভিন্ন মত, ভিন্ন আদর্শ মাথা চাড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তখনই সেই মতকে পদদলিত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ক্ষমতার অধিকারী, রক্ষক এবং ক্ষমতাবানেরা।
একই অবস্থা ছিল ৫০ বছর আগেও। তাই যখন কয়েক’শ ছাত্র-ছাত্রী ও এক দল সচেতন মানুষ প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের নান্তের ক্যাম্পাসে শ্রেণী-বিদ্বেষ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ডিং-এর পিছনে চলা আমলাতন্ত্র সম্পর্কে স্পষ্ট এবং শান্তিপূর্ণ মতামত রাখতে জড়ো হয়, তা ভীত করে সরকারকে। ভীত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে, যার ফলস্বরূপ ঐতিহাসিক ফরাসি ছাত্র আন্দোলনের সূচনা। ১৯৬৮ সালের মে মাসে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের নান্তের এবং সর্বন ক্যাম্পাসে চলতে থাকে পুলিশ এবং ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ। প্রশাসনের তরফে হুমকি দেওয়া হয়, আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা ছাত্ৰ-ছাত্রীদের বহিষ্কার করা হবে। ফ্রান্সের বৃহত্তর ছাত্র ইউনিয়ন ইউএনইএফ-এর নেতৃত্বে ২০ হাজার ছাত্র, শিক্ষক এবং সমর্থকের মিছিল বন্ধ হয়ে থাকা সর্বন ক্যাম্পাসের দিকে রওনা দেয়। যা ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে এবং কয়েকশ ছাত্র গ্রেফতার হয়। আন্দোলন বৃহদাকার ধারণ করে। সংঘর্ষ, গ্রেফতার চলতে থাকে। সচেতন মানুষ, কবি, শিল্পী, লেখক, প্রভৃতি আন্দোলনে শামিল হন।
এই আন্দোলন শুধুমাত্র ছাত্ৰ রাজনীতির বলয়ে আটকে থাকেনি, কারণ সংকটটা সামগ্রিক। এতদিন যাবৎ যে শ্রমিক ইউনিয়নেগুলি ছাত্র রাজনীতির পণ্য-বর্জন নীতির পরিপন্থী ছিল, তারাও আন্দোলনের অংশ হয়ে ওঠে। ১৯৬৮ সালের ১৩ মে বৃহত্তম বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন সিজিটি এবং সিজিটি-এফও একদিনের ধর্মঘট ডাকে। পুলিশি জুলুম যত বাড়তে থাকে, তত বেশি মানুষ আন্দোলনে পা মেলাতে থাকে। সর্বন ক্যাম্পাস চালু করার এবং নিঃশর্ত বন্দি মুক্তির দাবিতে লক্ষাধিক মানুষ মিছিল করে। রাজনৈতিক চেতনা প্রভাব বিস্তার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের বাইরে। ওডিঅন থিয়েটারের প্রবেশদ্বারে কেউ লিখে রেখে যায়, “When the National Assembly becomes a bourgeois theater, all the bourgeois theaters should be turned into national assemblies.” বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে যায় বিভিন্ন স্তরে, ইন্ধন জোগায় সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তম আন্দোলনের। লাখে লাখে শ্রমিক সরকারি জুলুমবাজির বিরুদ্ধে এবং বেতন বৃদ্ধি, নুন্যতম মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘটে বসে। ফরাসি ছাত্র আন্দোলন শুধুমাত্র ছাত্রদের ছাত্রসুলভ দাবি জানানোর মঞ্চ ছিল না, ছিল বৃহত্তর রাজনীতির কাঠামো গঠনের পরিধি। সেই রাজনীতি শ্রেণী, বর্ন, লিঙ্গ, যৌনতা সব পরিসরেই পরিবেষ্টন করেছে।

ফরাসি ছাত্র আন্দোলনে ৫০ বছর উপলক্ষে অ্যাকাডেমি চত্বরে অনুষ্ঠান

বিপ্লবের সাফল্য তার বিপ্লব হয়ে ওঠার মধ্যে, মানুষকে স্থিতাবস্থার থেকে নাড়া দেওয়ার মধ্যে, ক্ষমতার একনায়কতন্ত্রের দিকে পাথর ছুড়ে মারার মধ্যে। “I love you! Oh, say it with paving stones!” বিপ্লবের সাফল্য মানুষের মননে, যাপনে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বিস্তার করার মধ্যে। তাই ৫০ বছর পর সুদূর ভারতে যখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পুলিশ ঢুকিয়ে উপাচার্যের অপসারণের দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর হামলা করা হয়, আর তার প্রতিবাদে গোটা শহর রাস্তায় নেমে হোক-কলরবের মিছিলে হাঁটে, তখন ছবিটা বহু পরিচিত মনে হয়। ৫০ বছরের দোরগোড়ায় এমন পরিচিত ছবি বারবার দেখতে পাওয়া লজ্জার।

ভারতবর্ষ, যা কিনা বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, সেখানে নাগরিকের সরকারের দিকে সমালোচনার আঙ্গুল তোলার অধিকারকে খর্ব করা হচ্ছে অহরহ। একই ছবি ছাত্র রাজনীতিতেও স্পষ্ট। ভিন্ন মত আর দেশদ্রোহ সমার্থক শব্দে রূপান্তরিত হয়েছে। সরকার আর রাষ্ট্রের মধ্যেকার বিরাট ব্যবধান ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে ইচ্ছাকৃতভাবে। বলা হচ্ছে, সরকার, যে কিনা নাগরিকদের নিযুক্ত করা রাষ্ট্রের প্রতিনিধি মাত্র, তার বিরুদ্ধাচরণ দেশের অবমাননা। তাই সরকারের অসাংবিধানিক, অগণতান্ত্রিক কার্যকলাপে লাগছে রাষ্ট্রীয় সিলমোহর। তাই কানহাইয়া কুমার, উমর খালিদ, অনির্বাণ ভট্টাচার্য প্রমুখ ছাত্র যখন আফজাল গুরুর ফাঁসির ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়, তখন তাদের বরাতে থাকে গ্রেফতার ও অকথ্য অত্যাচার। সরকার এবং পুলিশ, যা কিনা ক্ষমতার শীর্ষে বসে আছে, তারা পরাক্রম দেখায় দেশের নিরস্ত্র সাধারণ ছাত্রদের ওপর। বিরুদ্ধ মত পোষণের দায়ে রোহিত ভেমুলাকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেওয়ার পর হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকার এবং সরকারের মদতপুষ্ট এবিভিপির অবস্থান অক্ষত থাকে। এই ছাত্র রাজনীতি বৃহত্তর রাজনীতিরই প্রতিফলন হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে যখন গৌরী লঙ্কেশ, সুজাত বুখারির মতো সাংবাদিকদের প্রাণ হারাতে হয় বিরুদ্ধ মত পোষণ করার জন্য। যখন নারী আন্দোলনের কর্মী সোমা সেন, বন্দিমুক্তি আন্দোলনের কর্মী রোনা উইলসন বা প্রগতিশীল আইনজীবী সুরেন্দ্র গ্যাডলিংকে গ্রেফতার হতে হয়, তখন ধরে নিতে হয় মানবাধিকার মৃত, গণতন্ত্রর শ্বাসরোধ করা হচ্ছে।

জেএনইউ-এ কানহাইয়া কুমার

এত কিছুর পরও মানুষ প্রতিবাদ করে, ছাত্ররা রাস্তায় নামে নিজেদের দাবি সোচ্চারে জানাতে, এটাই আশা জাগায়। তাই এখনও হোস্টেল ফেসিলিটি ও প্রবেশিকা পরীক্ষা বহাল রাখার দাবিতে যথাক্রমে কলকাতা মেডিকেল কলেজ ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা অনশনে বসে, পরীক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির দাবিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ স্ট্রিটে বিক্ষোভ দেখায়। একে অপরের ক্যাম্পাসে গিয়ে পাশে দাঁড়ায়, সলিডারিটি জানায়। এই অসম্ভব সময়ে দাঁড়িয়ে এখনও এই প্রজন্ম স্বপ্ন দেখে, জেরার্ড গেগার বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে, “Soyez réalistes, demandez l’impossible.” (Be realistic, ask for the impossible.) এখনও এক দল মানুষ থিয়েটার, বিজ্ঞান, কাব্যচর্চা, লেখালেখি, সংগীত, রাজনীতি, প্রভৃতি ভিন্ন ক্ষেত্র থেকে আসা একদল মানুষ এক শুক্রবারের বিকেলে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের সামনে গাছতলায় জড়ো হয় সৌরীন ভট্টাচার্য, শুভদীপ সিংহ মহাপাত্র, নন্দিনী ধরের মত জ্ঞানী গুণী মানুষের সাথে আলাপ আলোচনায় বসে ফরাসি ছাত্র বিপ্লবের সম্বন্ধে জানতে, বিশ্লেষণ করতে। ক্ষমতার রাজনীতি যতই আঘাত হানবে মুক্ত চিন্তার উপর, প্রতিঘাত ততই বাড়বে। বিভিন্ন আকারে, বিভিন্ন প্রকারে, বিভিন্ন পরিসর থেকে। বর্তমান ভারতে ছাত্র রাজনীতির উপর প্রত্যাশা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। অনেক দুর্গম পথ আসন্ন, অনেক কাজ বাকি। মনে রাখতে হবে, the question still remains, where is Najeeb?

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Leave A Reply

Your email address will not be published.