সামনে ২০২১ এর বিধানসভা ভোট। এর মধ্যে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল থেকে আমার শাসক দলে যোগ দেওয়া নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন কেন হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত? না, সিদ্ধান্তটা আচমকা নয়। আমি ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিজেপির সব পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলাম। পার্টির মেম্বারশিপ আর রিনিউ করিনি।
কেন বিজেপি ছাড়লাম
দলের সঙ্গে যা নিয়ে আমার মতপার্থক্য হয়, তার মূলে রয়েছে সিপিএম ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া নেতাদের তড়িঘড়ি পদে বসানোর প্রবণতা। আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ থেকে বিজেপি, সব জায়গাতেই এই প্রবণতা প্রকট আকার নিচ্ছিল। এই প্রবণতা, এই নীতির বিরোধিতা করেছিলাম। এটা কী হচ্ছে? কেন হচ্ছে? দলের মধ্যে বারবার এই প্রশ্ন তুলেও সদুত্তর মেলেনি। এখন তো বিজেপির রাজ্য সভাপতি বিভিন্ন জায়গায় স্পষ্ট বলছেন, ওনার পার্টি কর্মীদের দরকার নেই। উনি সিপিএম থেকে লোক এনে সংগঠন মজবুত করবেন এবং ভোটেও জিতবেন।
আমার রাজনীতিতে আসার বহু কারণের মধ্যে অন্যতম ছিল সিপিএম। তখন আমি আমহার্স্ট স্ট্রিট সিটি কলেজের ছাত্র। এসএফআই হোক বা সিপিএম, এদের একটা গাজোয়ারি প্রবণতা দেখেছি। দেখেছি, ‘সব কিছুই আমরা নিয়ন্ত্রণ করব’ রকমের ভাবনাচিন্তা। এই দাদাগিরি সুলভ আচরণ মেনে নিতে না পেরেই আমার প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আসা। তারপর বিজেপির নীতি, আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছি।
এটাও ঠিক যে, একটা দল বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে অন্য দলের নেতারাও আসবেন। কিন্তু যাঁরা অন্য দল থেকে আসছেন, তাঁদের বিভিন্ন পদে বসানোর একটা প্রক্রিয়া থাকাও তো জরুরি। কিন্তু যাঁরা আসছেন, তাঁরা এই দলের চিন্তাধারা, আদর্শই আয়ত্ত করে উঠতে পারেননি। কিছু হাস্যকর কাজ করছেন এঁরা। অন্য দল ছেড়ে যাঁরা বিজেপিতে আসছেন, তাঁদের আসল উদ্দেশ্য হল বিজেপির প্ল্যাটফর্মটা কাজে লাগানো। কারণ, আগের দলে থেকে তৃণমূলের সঙ্গে যুঝতে পারছিলেন না তাঁরা।
বর্তমান আর্থসামাজিক পরিস্থিতি এবং বিজেপির তথাকথিত উত্থান, এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়েছে সাধারণ মানুষের জন্য রাজনীতিটাই হচ্ছে না। কোথাও যেন বিজেপিরই হাত শক্ত করা হচ্ছে।
দ্বিতীয় কারণ হল, বিজেপির বাংলার দল হয়ে উঠতে না পারা। অন্য রাজ্যের বিজেপি নেতৃত্ব বাংলার সংগঠন চালানোর দায়িত্ব নিচ্ছেন। বাংলার সংস্কৃতি, চিন্তাধারা বোঝা তো দূর অস্ত, এঁরা চান নিজেদের রাজ্যের সংস্কৃতি, চিন্তাধারা বাংলার মাটিতে গ্রোথিত করতে। কিন্তু তা অসম্ভব। সংস্কৃতি নিয়ে এই রাজনীতির চেষ্টা এককথায় হয় না। উদাহরণ দিয়ে বলতে পারি, বাংলার কোনও তৃণমূল, কংগ্রেস বা সিপিএম রাজনৈতিক সভা করলে সেখানে প্রধান বক্তা থাকেন এ রাজ্যেরই মুখ। কিন্তু বঙ্গ বিজেপির সভায় বক্তব্য রাখছেন ভিন রাজ্যের কোনও শীর্ষ নেতা। এই ব্যাপারটা অপমানজনক। সর্বভারতীয় দল হিসেবে হতেই পারে বিজেপির নিজস্ব দিক আছে, লক্ষ্য আছে। কিন্তু কোনও দলের জনভিত্তি যত বৃদ্ধি পাবে সে রাজ্য বা অঞ্চলের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিকগুলোর সঙ্গে তো সম্পৃক্ত হতে হবে। নাহলে কীভাবে ওই অঞ্চলের মানুষের কাছের হওয়া যায়? কেন সেই রাজনৈতিক দলকে আপন ভাববেন মানুষ? কিন্তু বাংলায় বিজেপি ঠিক যেন উলটো উল্টো পথের পথিক। ভিন রাজ্যের সংস্কৃতি, চিন্তাভাবনা এখানে চাপানোর চেষ্টা চলছে। নেতাদের পোশাক, হাঁটাচলা, কথাবার্তা বাংলার আর পাঁচটা রাজনৈতিক দলের নেতার সঙ্গে আপনি মেলাতে পারবেন না। মনে হতে পারে গোরখপুর, বারাণসী, ভোপাল বা ইন্দোরের কোনও সংস্কৃতির প্রভাব বাংলায় আনার চেষ্টা হচ্ছে। একটু সোজা করে বলা যাক। দলের কোনও অনুষ্ঠানে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনের দায়িত্ব আমার বা আমার মতো কোনও ব্যক্তিত্বের হাতে দেওয়া হলে, আমরা আমিষ মেনু রাখতাম। কিন্তু তার উপর একটা চাপ পড়ত। বাধ্য করা হোত খাবারের পদ হবে নিরামিষ। এই অনুভূতিগুলি ভীষণ সূক্ষ্ম।
তৃতীয় কারণ, সরকার পরিচালনার ক্ষমতা। কেন্দ্রের শাসক দল এবং এ রাজ্যের শাসক দলের মেয়াদের খুব একটা বড় পার্থক্য নেই। কিন্তু শাসন পরিচালনা রকম দেখে বোঝা যায় যায় দুই সরকারের প্রশাসনিক ক্ষমতা এবং অভিজ্ঞতা। স্পাইডার ম্যান সিরিজে এক বিখ্যাত উক্তি সর্বজনবিদিত, ‘উইথ পাওয়ার কামস রেসপন্সিবিলিটি,’ অর্থাৎ কী না, ক্ষমতার সঙ্গে আসে দায়িত্ববোধ। বর্তমান দেশের অর্থনীতির দুরবস্থার কারণ হিসেবে কেন্দ্র দায়ী করছে অতিমারি করোনাভাইরাসকে। কিন্তু করোনার অনেক আগেই ভারতীয় অর্থনীতির নড়বড়ে চেহারা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। নোটবন্দি, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার ফান্ড থেকে অর্থ নেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি ব্যাঙ্কের সংযুক্তিকরণের সিদ্ধান্ত সেই দুর্বলতাকে নির্দেশ করছে। আবার বেসরকারিকরণের সময় এক অদ্ভুত জিনিস দেখা গেল। একটা সরকারি সংস্থা অন্য একটি সরকারি সংস্থাকে কিনছে। অর্থাৎ, সরকারের টাকাই আবার সরকারে চলে এলো। এই অর্থনৈতিক অব্যবস্থাকে এখন কোভিডের নামে ঢাকা হচ্ছে।
আবার এই করোনা পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকার যে যে পদক্ষেপ করেছে প্রথমে বিজেপি ঢাকঢোল পিটিয়ে তার বিরোধিতা করেছে। আবার দুইদিন পরে দেখা গিয়েছে রাজ্য সরকারের মতো নীতি ও পদক্ষেপই গ্রহণ করছে কেন্দ্র। অর্থাৎ, কেন্দ্রের সরকার চালানোর সুদূরপ্রসারী চিন্তার অভাব স্পষ্ট হচ্ছে। রাজ্য সরকারের দূরদৃষ্টিমূলক কাজই পরে কেন্দ্র চালু করছে। ফলত বঙ্গ বিজেপি রাজ্য সরকারের যে নীতি বা সিদ্ধান্তের সমালোচনা করছিল তা হাস্যকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
সরকার পরিচালনার আঙ্গিকে দেখলে একদিকে আমরা দেখতে পাব রাজ্য সরকারের সাকসেস মোড। অন্যদিকে কেন্দ্রের সরকার পরিচালনার চূড়ান্ত ব্যর্থতা।
বাজপেয়ী সরকারের সময় একটা স্লোগান ছিল, ”হর হাত কো কাম, হর খেত কো পানি”। মোদী সরকারের শাসনে গত ছ’বছরে তা কতটা সফল হয়েছে তা নিয়ে ধন্দ আছে। এই সরকার পূর্ণ সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে কাজ করছে। কিন্তু এই ক’বছরে কেন এই কাজগুলি হয়নি? গত ৪৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেকারত্বের সম্মুখিন হয়েছে ভারতবর্ষ। কোথায় ‘হর হাতকো কাজ’?
কেন আমি তৃণমূলে
একুশে জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জির বক্তব্য আমাকে আকৃষ্ট করেছে। তাছাড়া সিপিএম জমানা থেকে তৃণমূল শাসনে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে রাজ্যের। রাস্তাঘাট থেকে হাসপাতাল পরিষেবা সবেতেই উন্নয়নের ছোঁয়া স্পষ্ট। বিজেপি কেন্দ্রে ৬ বছর আছে, তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় আছে ৯ বছর। কিন্তু কাজ করার তফাত বিশাল। রাজ্য সরকার তার লিমিটেড রিসোর্স দিয়ে, বিপুল দেনা শোধ কাজ করে চলেছে। কেন্দ্র সে জায়গায় ব্যর্থ। ভোটের আগে দুই দলের প্রতিশ্রুতি এবং ক্ষমতা দখলের পর তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষার পদক্ষেপের দিকে চোখ রাখলে ফারাকটা চোখে পড়েই।
তাছাড়া, গত কয়েক বছর আগেই দলের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল। আর রাজনীতি না করে ঘরে বসে খুঁত বের করার চেয়ে সক্রিয় রাজনীতি করাই ভালো বলে মনে হয়েছে। ২০২১ সালে আবার তৃণমূলকে রাজ্যে ক্ষমতাই আনাই আমাদের লক্ষ্য। বাংলায় বিজেপি এলে তা মারাত্মক হবে। ভিন রাজ্যের নীতি-আদর্শ এখানে চালানোর চেষ্টা হবে, সামাজিক ও অর্থনীতির সমূহ ক্ষতি হবে। উত্তরপ্রদেশ মডেল বাংলার হতে পারে না। রাম মন্দির তৈরির কাজ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কোভিড পরিস্থিতিতে দরকার ভালো হাসপাতাল পরিষেবা। রাম মন্দির তৈরির কাজ দু’ বছর পিছিয়ে গেলে কোনও ক্ষতি হত কি?
বাংলায় মমতা ব্যানার্জির কোনও বিকল্প নেই। তৃণমূলকেই আবার আসতে হবে। দিদিকেই আবার মুখ্যমন্ত্রী হতে হবে।