Lockdown: কোনও অ্যাসাইনমেন্টে মৃত্যুভয় হয়নি, কিন্তু এবার এক অদৃশ্য অস্বস্তি ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে সারাক্ষণ
এ যেন ঠিক দূর থেকে দেখছি একটা ট্রেন আসছে। ভাবছি, এখনও তো অনেক দূর। হঠাৎই ট্রেনটা বুলেটগতিতে একদম গায়ের কাছে এসে পড়ল হুড়মুড়িয়ে। অমনি দিক-বিদিক ভুলে দৌড়ে বাঁচার চেষ্টা। সেদিনও স্ট্রিট ফাইট অনুষ্ঠান করতে গিয়েছি বালিগঞ্জে, পরের দিনের লোকেশনও ফাইনাল। হঠাৎই বসের মেসেজ, কাল থেকে আপাতত বাইরে নয়। শো হবে স্টুডিও থেকেই। এরপর শো শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে অফিস গ্রুপে সহকর্মীর পোস্ট, বিগ ব্রেকিং, কলকাতায় করোনা আক্রান্ত ইংল্যান্ড ফেরত তরুণ। তারপরের ঘটনা সবার জানা। প্রথমে জনতা কার্ফু, তারপর রাজ্যজুড়ে লকডাউন আর এই মুহুর্তে গোটা দেশ তিন সপ্তাহ তালাবন্দি।
এমনিতে এরকম সময়টা আমাদের সাংবাদিকদের জন্য ভীষণ এক্সাইটিং হওয়ার কথা। বিশ্বজুড়ে ত্রাহি ত্রাহি, নজিরবিহীন লকডাউন, খবরের ঘনঘটা মানেই তো সাংবাদিকের সেই চিরাচরিত অ্যাড্রিনালিন রাশ। ২৪ ইনটু ৭ দৌড়নোর মোক্ষম সময়। কিন্তু এই করোনা পরিস্থিতি ভীষণ রকম আলাদা। প্রটোকল মেনে হাতে গোনা কয়েকজন নিউজরুমে, বাকিরা ওয়ার্ক ফ্রম হোম! ওয়ার্ক প্লেসেও সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং, ক্ষণে ক্ষণে হাতে স্যানিটাইজার স্প্রে।
২৬/১১ হোক বা আয়লা, গোটা দেশ যখন থমথমে, নিউজ রুম সেসময় খইয়ের মত ফোটে। আর এখানেই বর্তমান পরিস্থিতি একদম আলাদা। ছমছমে। লকডাউন বা অনির্দিষ্টকাল বন্ধের অভিজ্ঞতা আমরা যাঁরা দার্জিলিংয়ে বিভিন্ন সময় কাজ করেছি তাঁদের কাছে নতুন কিছু নয়। শুনশান রাস্তা-ঘাট, দোকানপাট বন্ধ, খাবারের সংস্থান নেই, সন্ধে নামলেই নিশুত রাতের স্তব্ধতা, এসব তো খুবই চেনা। মৃত্যুভয়? সত্যি বলতে কি, এত বছরের কর্মজীবনে সেটাও কখনও কাবু করতে পারেনি। লালগড় হোক বা দান্তেওয়ারা, অনেক হাড় হিম করা পরিস্থিতির সাক্ষী। কাজের উত্তেজনায় মৃত্যুভয় সব সময় ব্যাকসিটে চলে গিয়েছে। কিন্তু এবারের অনুভূতি একদম আলাদা। ভয় বলব না কিন্তু এক অদৃশ্য অস্বস্তি ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে সারাক্ষণ।
না, লকডাউনে আমার রোজনামচায় খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। আর পাঁচটা দিনের মত অফিসের তাড়া সকাল থেকে। ঘুমচোখেই ফোন, হোয়াট্সঅ্যাপে কাজের ব্যস্ততা। অফিস ছোটা। দিনের শেষে ঘরে ফেরা। এতে তো বদল নেই কোনও। নেই কোনও আপাত ছন্দপতন! তবু সব কিছু কেমন অন্যরকম! আসলে ভীষণ একটা দমবন্ধভাব গ্রাস করছে চারপাশ, আর সেই ফাঁস থেকে বেরতে পারছেন না সাধারণভাবে নৈর্ব্যক্তিক থাকতে শেখা সাংবাদিকও। কারণ, শত্রুটা অজানা। দরজার বাইরে পা রাখা মানেই অবচেতনে তার পদধ্বনি শোনা। আমার যে সহকর্মীরা হাসপাতাল চত্বরে সারাদিন কাজ করছেন, তাঁদের থেকে শুরু করে সটুডিওতে বসা আমি, বাড়িতে বসে লাইভ দেওয়া বিশেষজ্ঞ থেকে আমাকে অফিস পৌঁছে দেওয়া গাড়ির চালক, গৃহবন্দি থাকা আমার আপনার পরিজন, সবার জন্য একটা শব্দ কমন, ভালনারেবল। কেউ জানিনা, কে কখন নিজের অজান্তেই মারণ ভাইরাসের ক্যারিয়ার হয়ে কার বিপদ ডেকে আনব। তাই সাংবাদিকের সহজাত খবর নিয়ে উত্তেজনাকে ঘিরে থাকছে একজন সাধারণ মানুষের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা।
সেক্টর ফাইভে তথ্য প্রযুক্তি তালুকে আমার অফিস। এসডিএফ, কলেজ মোড়, ঝিলপাড় দিন-রাত গমগম করে। সেখানে এখন শুধুই শূন্যতা। মনে হয় প্রেতপুরী। চারদিক খাঁ খাঁ। কড়া স্ক্রিনিংয়ের মধ্যে দিয়ে অফিস ঢোকা। সারাদিন শুধুই করোনার খবর। করোনা নিয়ে আলোচনা। সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং মেনে বক্তারা সব নিজের নিজের বাড়ি থেকে লাইভে, ভরসা প্রযুক্তি। হরিপদ কেরানি থেকে আকবর বাদশার যে উৎকণ্ঠা, সেই একই উৎকণ্ঠা নিয়ে অপেক্ষা, কী বলে আজ স্বাস্থ্য মন্ত্রক? আজ কি একটু কমবে নতুন আক্রান্তের হার? সন্ধে হলেই সবার একই চিন্তা, আজ রাজ্যে নতুন সংক্রমণ নেই তো? আর অফিসের গ্রুপে হেলথ বিটের দায়িত্বে থাকা সহকর্মী টাইপিং দেখালেই জোরাল লাবডুব, কী হয় কী হয়! নতুন করে আক্রান্ত বা মৃত্যুর খবর এলেই একরাশ হতাশা আর উৎকণ্ঠা বুকে চেপে কোনও সহকর্মী ব্রেকিং লিখতে শুরু করে দ্রুত হাতে, স্টুডিওয় প্রোডাকশন কন্ট্রোল রুম থেকে ইয়ার ফোনে বার্তা, আরও একজন আক্রান্ত, রিপোর্টার ফোনে থ্রু।
সারাদিন কাজের শেষে এমনিতে আমি খুব ফুরফুরে মেজাজে বাড়ি ফিরি। ক্লান্তি টান্তি আমায় তেমন ধরাশায়ী করতে পারে না। কোনও ঘটনাবহুল দিনে তো আরও বেশি। যত অ্যাড্রিনালিন রাশ, তত এনার্জি। বলতে দ্বিধা নেই, বর্তমান পরিস্থিতি ব্যক্তি আমির যে পজিটিভিটি তাতে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলছে। চারদিকে শ্মশানের স্তব্ধতা। শুনশান বাইপাস ধরে বাড়ি ফেরা। বাইপাসের ধারে প্রাসাদোপম পাঁচতারা প্রাণহীন দাঁড়িয়ে। এই তো সেদিনও এত মানুষ, খাওয়া দাওয়া, বিয়ে-জন্মদিন, প্রেম-অপ্রেম, হাসি-ঝগড়ায় মুখর থাকত। কোনও দুষ্টু জাদুকরের ব্ল্যাক ম্যাজিকে সব যেন হাওয়া এক লহমায়। গোটা শহরের প্রাণশক্তি শুষে নিয়েছে এই অদৃশ্য ভাইরাস।
তবু এই শূন্যতা শেষ কথা নয়। শেষ কথা বলবে আমাদের সম্মিলিত লড়াই। স্ট্রাইকিং পজিশনে নিজের জীবন বাজি রেখে লড়ছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীরা। কোনও কুর্ণিশই তাঁদের জন্য যথেষ্ট নয়। পুলিশ প্রশাসন দৌড়ে বেড়াচ্ছে মাঠজুড়ে। এই অবুঝ মানুষদের ঘরে ঢোকাচ্ছেন তো পর মুহুর্তেই গরিব মানুষের হাতে পৌঁছে দিচ্ছেন খাবারের প্যাকেট, আসন্নপ্রসবা মহিলাকে হাসপাতালে পৌঁছচ্ছেন তো, কোথাও নিজেরাই রক্ত দিয়ে প্রাণ বাঁচাচ্ছে মুমূর্ষু রোগীর। আপনাদের কাজ শুধু রক্ষণটা সামলানো। জাস্ট ঘরে বসে। সেই কাজটা করতেই হবে। আপনাদের কাছে সঠিক খবরটা পৌঁছতেই কিন্তু দিন-রাত এক করে কাজ করে চলেছি আমরা, সব সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা। যাতে ঘরবন্দি আপনার ড্রয়িংরুমে বা হাতের মুঠোয় গোটা বিশ্বটাকে পৌঁছে দিতে পারি।এই টিম গেমটাই একমাত্র ভরসা দিতে পারে অভূতপূর্ব এই সঙ্কটে। লড়াইটা আমাদের জিততেই হবে। তার জন্য পজিটিভ থাকাটাও খুব জরুরি। সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মানেই মানসিক দূরত্ব নয়। ফোনে, সোশ্যাল মিডিয়ায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বা ইউরোপ, আমেরিকায় ছড়িয়ে থাকা বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করছি নিয়মিত। সব জায়গার পরিস্থিতি জানার পাশাপাশি মানসিকভাবে বেঁধে বেঁধে থাকছি। আতঙ্ক যেন আমাদের দুর্বল করতে না পারে। আর আমরাই পারি একে অন্যকে ভরসা জোগাতে। ভালবাসা, উষ্ণতা তো বটেই, রসবোধও হাতিয়ার এই কঠিন সময়কে চ্যালেঞ্জ ছুড়তে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাল সময়ের ছবি পোস্ট করছি, যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাকে ফলো করেন, আমাকে সারা বছর প্রেরণা জোগান, উৎসাহ দেন,এই সঙ্কটে তাঁদের মোটিভেট করার দায় আছে বলে আমি বিশ্বাস করি। এখন আমার ফিরিয়ে দেওয়ার সময়। তাই তাঁদের কাছে আবেদন করছি, বাড়িতে থাকতে, তাঁদের জন্য পজিটিভ ভাইব ছড়ানোর চেষ্টা করছি। আর অপোক্ষা করছি সেই ভোরের, যেদিন আবার সূর্যের দিকে হাত বাড়িয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারব।
Comments are closed.