ভয়ের রাজ্যে হিংসার বেসাতি

এক মিনিটের জন্যে বেগুনি-জামা-পরা, বাদামি চুলের, জ্বলজ্বলে চোখের ফুটফুটে মেয়েটার মুখটা মন থেকে সরিয়ে ফেলুন। খুব কঠিন, জানি, তাও একটু কষ্ট করে করুন।

এবার একজন পুরুষের কথা ভাবুন। বছর ষাটেক বয়স, এক প্রাপ্তবয়স্কের বাবা, আর এক অপ্রাপ্তবয়স্কের মামা। বাবারা অংক শেখান, গ্রামে চাষের কাজও শেখান, মামারা পাখির ডাক চিনতে শেখান, রোমাঞ্চকর গল্প শোনান। এখানে আমরা দেখছি একজন বাবা ও মামাকে যিনি পরবর্তী প্রজন্মকে একটু অন্যরকম শিক্ষা দিচ্ছেন — শেখাচ্ছেন অপহরণ, ধর্ষণ, হত্যা। প্রত্যেকটিই বর্তমান ভারতের জন্য উপযুক্ত লাইফ স্কিল, এ-ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।

ছবিটা এখনো ঠিক তৈরি হচ্ছে না? আর একবার ভাবুন — পাহাড়ের গায়ে একটা মন্দির। তার ভেতর মামাতো-পিসতুতো দুই ভাই মনের সুখে ধর্ষণ করছে প্রায়-সংজ্ঞাহীন এক শিশুকে। সংজ্ঞা যাতে না ফেরে পুরোপুরি, তার জন্যে এপিট্ৰিল ট্যাবলেট খাওয়ানো হচ্ছে মাঝে মাঝে। পুলিশ-বন্ধুরা এসে ধর্ষণ-ধর্ষণ খেলায় যোগ দিচ্ছে। মামা/বাবা এসে দেখে যাচ্ছেন প্ল্যান-মাফিক সবকিছু চলছে কি না। তারই নিপুণ পরিচালনায় মন্দিরে পুজো-আচ্চা চলছে রোজকার মতো, তার সঙ্গে তন্ত্রসাধনা-জাতীয় কিছু আচার যোগ করা হচ্ছে এই বিশেষ উপলক্ষে। তিন দিনব্যাপী ধর্ষণ-উৎসব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ার পর, সমবেত ভক্তমণ্ডলীর কাম চরিতার্থ হওয়ার পর, প্রতিমা বিসর্জন, অর্থাৎ যথোপযুক্ত নির্মমতার সঙ্গে হত্যা এবং মৃতদেহ অপসারণ।

বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়-ওয়েবসাইটে আরো বিস্তারিত বর্ণনা সকলেই পড়েছেন। পড়তে পড়তে শিউরে উঠেছেন, কেঁদে ফেলেছেন, আর ভেবেছেন, কাঠুয়ার শিশুটি আমারই সন্তান। ঠিক যেমন ভেবেছিলেন, নির্ভয়া আমার মেয়ে, আমার বোন, আমার প্রেমিকা।

একবারও ভেবেছেন, সাঁঝি রাম আমার বাবা, শুভম, মন্নু আর বিশাল আমার ভাই, দীপক আমার কাকা?

ভুলটা এখানেই। আমাদের ঘরে-ঘরে আজ কাঠুয়ার নির্যাতিতা, নির্ভয়া, কারণ আমাদের বাড়িতে, আমাদের পাড়াতেই সাঁঝি রাম, দীপক, শুভমদের বাস। বছর দশেক আগেও তারা ছিলেন পরিমলজেঠু, রমেনকাকু, ব্যানার্জিদা, বাবাই, টোটো, সন্দীপ। অফিসে কাজ বা স্কুলে পড়াশোনা কম করলেও পুজোর চাঁদা তোলা থেকে রক্তদান শিবির বা ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন করায় তাদের উৎসাহের্ কোনো খামতি ছিল না। সংখ্যালঘু-প্রীতি না থাকলেও হিন্দুধর্মকে বর্ম করে পরার প্রবণতাও তেমন ছিল না। আর অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সময় কোন পক্ষের কী ধর্ম সেটা আগে জেনে নেওয়ার প্রয়োজন ছিল না। এখন আছে। আর আছে ‘ওদের’ শিক্ষা দেওয়ার অদম্য ইচ্ছা। যাতে ‘ওরা’ কখনো নিজেদের আওকাতের (নাহ, অনেক ভেবেও এই শব্দটার যুৎসই বাংলা পাওয়া গেল না) বাইরে যাওয়ার সাহস না পায়।

‘ওরা’ কারা? অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুসলমান সম্প্রদায়ের লোক। কখনো দলিত। কখনো মণিপুরী বা নাগা যুবক-যুবতী। কখনো এ-দেশে পড়তে বা খেলতে আসা আফ্রিকান ছেলে।

আর যদি একইসঙ্গে মুসলমান এবং কাশ্মীরি এবং যাযাবর-উপজাতিভুক্ত কাউকে পাওয়া যায়, তা হলে?

তা হলে কী হয়, আমরা কাঠুয়ায় দেখলাম।

উন্নাওয়ে ‘ওরা’ হতে দেখলাম, গরিব, নীচু জাতের পরিবারকে।

কিন্তু এর পরেও কেউ কেউ বলবেন ধর্ষণের সঙ্গে ধর্ম ও রাজনীতিকে না জড়াতে। কাঠুয়ায় সাঁঝি রাম এবং তার সঙ্গীরা যে আর কোনো উপায় রাখেননি। রীতিমতো কয়েক হপ্তার পরিকল্পনার ফল আট বছরের শিশুর ধর্ষণ ও হত্যা। উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশও রাখেননি তারা। অভিযুক্ত নাবালক তার জবানিতে বলেছে স্থায়ী বসবাসহীন মুসলমান উপজাতি গুজ্জর-বাখারওয়ালদের ভয় পাওয়ানো, এবং জঙ্গলের রাজা কারা, সেটা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এই পৈশাচিক ধর্ষণ ও খুন। এর প্রতীকী তাৎপর্য — হিন্দুধর্মের দ্বারা ইসলামের ধর্ষণ, এবং ভারতকর্তৃক দেশদ্রোহী কাশ্মীরিদের ধর্ষণ — নিয়েও যাতে কোনো দ্ব্যর্থতা না থাকে, সেই জন্যে দেবীস্থান মন্দিরেই ঘটলো সবকিছু।

আশ্চর্য লাগলেও সত্যি, ক্রমশঃ বেড়ে চলা এই জাতীয় অপরাধের পেছনে প্রতিহিংসার থেকে বড় কারণ ভয়। সাঁঝি রাম হয়ে ওঠা পরিমলজেঠুরা ভয় পান, যে ‘ওরা’ হিন্দুদের ধ্বংস করার জন্যে অপেক্ষায় আছে, অতএব ‘ওদের’ কোনোভাবেই বাড়তে দেওয়া চলবে না। প্রতি পদে ওদের বুঝিয়ে দিতে হবে ওদের জায়গা অনেক নীচে। আর এই ভয়ের আগুনে ঘৃতাহূতি দিতে হোয়াটস্যাপে ঘুরে বেড়ানো কিছু ভিত্তিহীন গল্পই যথেষ্ট।

অথচ স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে যে-কটি বড় দাঙ্গা হয়েছে, প্রত্যেকটির বৃহত্তম শিকার সংখ্যালঘুরা। গত দুই-তিন দশকে হিন্দু ও মুসলমান দুই সম্প্রদায়েরই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে। কিন্তু ২০১১ সালের পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯১-২০০১-র সঙ্গে তুলনা করলে ২০০১-২০১১-র মধ্যে মুসলমান লোকসংখ্যা বৃদ্ধির হার (২৯.৫২ বনাম ২৪.৬০ শতাংশ) হ্রাস পেয়েছে হিন্দুর জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারের (১৯.৯২ বনাম ১৬.৬০ শতাংশ) চেয়ে দ্রুত গতিতে। মানে, এই গতি বজায় থাকলে দেশে মুসলমানদের সংখ্যা হিন্দুদের ছাপিয়ে যাওয়ার ভয় শুধু ভিত্তিহীন নয়, রীতিমতো হাস্যকর।  শিক্ষা, চাকরি, এবং জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে সুযোগসুবিধার নিরিখেও সংখ্যালঘুরা অনেক পিছিয়ে। কিন্তু পরিমলজেঠুদের এটা কে বোঝাবে? বালিতে মুখ ডুবিয়ে বসে না থাকলে বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কোনো কারণ নেই কারা পরিমলজেঠুদের মনে ভয় ঢোকাতে এবং জিইয়ে রাখতে উদগ্রীব। তারাই সাঁঝি রামদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে মিছিল করেন জম্মুতে, উন্নাওয়ে ভয় দেখান সাংবাদিকদের, আসানসোলে,মুজাফফরনগরে সলতেয় আগুন ধরান।

ভয় – হিংসা – প্রতিহিংসার ভয় — এই বৃত্ত থেকে বেরোনোর রাস্তা আমাদের নিজেদেরকেই তৈরি করতে হবে। ঔপন্যাসিক অনুরাধা রায় সম্প্রতি একটি লেখায় লিখেছেন, সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে আমরা কীই  বা করতে পারি, এই ভেবে অনেক সময়েই আমরা নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখি। কখনো বা ভাবি আমরা যেটা ভালো পারি, তা সে লেখাই হোক, বা কাঠখোদাইয়ের কাজই হোক, তার মধ্যে দিয়ে আমরা সমাজের ভালো করার চেষ্টা করে যেতে পারি। কিন্তু যে সমাজে স্রেফ একটি ধর্মের মানুষকে শিক্ষা দেবার জন্যে একটি আট বছরের শিশুকে নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়, গরীব দিনমজুরকে কুপিয়ে খুন করে তার ভিডিও তুলে রাখা হয়, গোমাংস ভক্ষণের ‘অপরাধে’ প্রকাশ্য রাস্তায় নির্দয় প্রহার করা হয় মানুষকে, সেই সমাজে এই দূরত্ব বজায় রাখার ইচ্ছে শুধু বিলাসিতা নয়, নিজেকে পরোক্ষভাবে হিন্দুত্ববাদীদের দলে শামিল করাও বটে।

তার চেয়ে চলুন নেটফ্লিক্সে আউশউইৎজ নিয়ে একটা চমৎকার তথ্যচিত্র দেখাচ্ছে, সেটা দেখা যাক বরং।  কী ভয়ংকর মানুষ ছিল ওই নাৎসীগুলো!

ছবি সৌজন্যে, অরিজিত সেন

Leave A Reply

Your email address will not be published.