অধীরকে সরিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুবিধা হল যাঁরা ভাবছেন, তাঁরা সম্ভবত ভুল ভাবছেন

‘বড়দা’ গিয়ে ‘ছোড়দা’ এলেন। ছোড়দা সোমেন মিত্র মহাশয় বহুকালের কংগ্রেস সৈনিক। দীর্ঘদিন প্রদেশ সভাপতির দায়িত্ব সামলেছেন । বহরমপুরের বড়দা অধীর চৌধুরী নিজের প্রচেষ্টায় বিধায়ক, সাংসদ হয়েছিলেন। অবশ্যই উভয়েই যোগ্য নেতা। ২০১৬ র বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে বামেদের সাথে জোটে যাওয়ার জন্য অধীর-সোমেন উভয়েই উদগ্রীব ছিলেন। সুতরাং আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে জোট প্রসঙ্গে কে কোনদিকে যেতে পারেন সেটা সম্ভবত সভাপতি পাল্টানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ কোনও সমস্যা এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্ধ বিরোধিতা অধীর চৌধুরী করছেন বলেই তাঁর এমন দুর্দশা হলো এমনটা মনে করার কোনও কারণ নেই।
বস্তুত অধীরবাবুর মমতা বিরোধিতা করার রেকর্ড তত স্পষ্ট নয়। তিনি মুর্শিদাবাদ জেলায় একসময়ে আরএসপি করতেন। পরে কংগ্রেসের নেতা হন। ১৯৯১ তে জেলে বসে নবগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রে জয়লাভ করেন। অধীরবাবুর মূল শত্রুতা ছিল সিপিএমের সাথে । যেমনটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও ছিল। কিন্তু নানাবিধ অপরাধের অভিযোগে অধীরবাবুকে বামফ্রন্ট সরকার একাধিকবার গ্রেফতার করে। পুরো নয়ের দশক জুড়ে তিনি ছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলায় সিপিএম বিরোধিতার প্রধান মুখ। ২০০৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন শুধু মুর্শিদাবাদ জেলাতেই সিপিএম-কংগ্রেস সংঘর্ষে একাধিক খুন হয়। কংগ্রেস জেলা পরিষদ দখল করে নেয়। অধীরবাবু তখন ছিলেন সিপিএমের প্রধান প্রতিপক্ষ। সুতরাং তিনিই যখন ২০১৬ তে এসে সিপিএমের সাথে গাঁটছড়া বাঁধলেন তখন অবশ্যই সিপিএম বিরোধী কংগ্রেস মনোভাবাপন্ন জনতার কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। এর ফলে প্রথাগত কংগ্রেস ভোটের একটি বড় অংশ তৃণমূলের দিকে ঘুরে গেছে । নেতা, বিধায়কেরা তো গেছেনই।
অপরদিকে মমতা বর্ণিত ‘তরমুজ ‘ যাঁরা ছিলেন তাঁদের পুরোভাগে অবশ্যই সোমেন মিত্রের নাম করতে হয়। নয়ের দশকের গোড়ায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে তাঁর কংগ্রেস সভাপতি পদ নিয়ে ভোটযুদ্ধ হয়েছিল। তিনি জয়ী হয়ে সভাপতি হয়েছিলেন। পরবর্তী ইতিহাস সবার জানা। মমতাকে কংগ্রেস রাজনীতিতে কোনঠাসা করার নেপথ্য নায়ক যে তিনিই এ কথাও সবাই জানেন। সিপিএম বিরোধী জনতা যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই বিশ্বাস করেছিল, সোমেন মিত্রকে নয় তার প্রমাণ তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রদেশ কংগ্রেসের ‘মামু’ (সৌজন্যে, সুমন চট্টোপাধ্যায়) কংগ্রেসে পরিণত হওয়া। মালদা, মুর্শিদাবাদ এবং উত্তর দিনাজপুর জেলা ছাড়া বৃহত্তর দক্ষিণবঙ্গে বস্তুত আর কংগ্রেসের কোন অস্তিত্ব রইলো না। এই পরিস্থিতিতে ২০০৮ সালে সোমেন মিত্র মমতার হাত ধরলেন । সিঙ্গুরে গিয়ে ধরণা দিলেন। সাংসদ হলেন। পত্নী শিখা মিত্র বিধায়ক হলেন। ছোড়দা আর দিদির সংসার একান্নবর্তী হ’ল।
কিন্তু মানুষের মনে প্রশ্ন রয়ে গেল যে দিদিকে যদি ছোড়দার জন্যই পৃথক গৃহনির্মাণ করতে হয়ে থাকে তবে নতুন সংসারে কি আবার কখনও গোলযোগ হতে পারে? কে না জানে গোলাপে কন্টক থাকে। ছোড়দা আর বৌদি ২০১৪ তেই দিদির সংসার ত্যাগ করলেন। আবার কংগ্রেস। কিন্তু একবার রাজনৈতিক লাইন ভুল করলে জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়। তাই নিজের খাসতালুক উত্তর কলকাতাতেই হেরে গেলেন ছোড়দা। তিনি বুঝতেই পারেননি পায়ের তলার মাটি কখন তৃণমূল হয়ে গেছে।
সেই একই ভুল করেছেন বড়দা। সিপিএম বিরোধিতা করে যাঁর উত্থান তিনিই সিপিএমের সাথে জোটে গেলেন। প্রতিটি রাজনৈতিক নেতার একটি identity থাকে, মানুষের কাছে। সেটা কখনও নষ্ট করতে নেই। তাহলে জনভিত্তি থাকে না।
২০১৯ এ বড় প্রশ্ন, এ রাজ্যে কংগ্রেস-বাম জোট হবে কিনা। ঘন ঘন অবস্থান পাল্টানো ব্যক্তি রাজনীতিকদের কথা বাদ দিচ্ছি। কিন্তু ঘটনাক্রম অনুযায়ী ২০১৬ র বিধানসভা নির্বাচনে একমাত্র দেবপ্রসাদ (মিঠু) রায় ছিলেন সেই কংগ্রেস নেতা যিনি বামেদের সাথে জোটে যেতে চাননি এবং সেই জন্য ভোটেও দাঁড়াননি। এবার সোমেন মিত্রের সাথে যে কমিটি এআইসিসি ঘোষণা করেছে তাতে মিঠুবাবুর নাম নেই। অতএব ধরে নেওয়া যেতে পারে সোমেন মিত্র, দীপা দাশমুন্সিরা বামেদের সাথেই জোটে আগ্রহী হবেন। রাজীব গান্ধীর বিশেষ স্নেহভাজন মিঠু রায়কে রাজীব তনয় কেন গুরুত্ব দিলেন না, বোঝা গেল না। অতএব যাঁরা ভাবছেন যে, অধীরবাবুকে সরিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুবিধা হলো তাঁরা সম্ভবত ভুল করছেন ।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Comments are closed.