ভীমা কোরেগাঁও মামলায় মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেফতারের এক বছর পূর্ণ, কেমন আছেন সোমা সেন, সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, রোনা উইলসনরা?

২০১৮ সালের ৬ ই জুন। ভিমা কোরেগাঁও মামলায় ৫ মানবাধিকার কর্মীকে গ্রেফতার করেছিল মহারাষ্ট্র পুলিশ। তারপর পেরিয়ে গিয়েছে পুরো একটি বছর। কেমন আছেন আইনজীবী সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজির অধ্যাপক সোমা সেন, কবি ও প্রকাশক সুধীর ধাওয়ালে এবং মানবাধিকার কর্মী মহেশ রাউত ও রোনা উইলসনরা? কতটা অগ্রগতি হল মামলার? গ্রেফতারির এক বছর পর এখনও এই ৫ জন বন্দি পুণের ইয়েরওয়াড়া জেলে।
মাস ছয়েক আগেই পুণে পুলিশ ভিমা কোরেগাঁও মামলায় চার্জশিট পেশ করে। কিন্তু তারপরও মামলায় কোনও অগ্রগতি হয়নি বলে সূত্রের খবর। জামিনও পাননি গ্রেফতার হওয়া ৫ মানবাধিকার এবং সমাজকর্মী। ধৃতদের পরিবারের তরফে অভিযোগ, বিশেষ উদ্দেশে আদালতে মামলা দীর্ঘস্থায়ী করা হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত পুলিশ আদালতে তাদের দাবির স্বপক্ষে এমন কোনও যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ পেশ করতে পারেনি, অথচ একটার পর একটা শুনানির দিন পেরিয়ে যাচ্ছে।

কী কারণে গ্রেফতার
২০১৮ সালের ১ লা জানুয়ারি মহারাষ্ট্রের পুণেতে ভিমা কোরেগাঁওয়ে জমায়েত হয়েছিলেন লক্ষ লক্ষ দলিত ও আদিবাসী মানুষ। কোরেগাঁও যুদ্ধের ২০০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সেখানে বসেছিল এক বিরাট সমাবেশ। ২০১৮ সালের সমাবেশে হিংসার ঘটনা ঘটে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত দলিত ও আদিবাসীদের উপর হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে এলাকার কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন এবং উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে। নাম জড়ায় মোদী ঘনিষ্ঠ সাম্ভাজি ভিডে এবং মিলিন্দ একবোটের। কিন্তু পুলিশ ঘটনার তদন্ত শুরু করার পরই আশ্চর্যজনকভাবে বদলে যায় মামলার অভিমুখ। ভিডে কিংবা একবোটের বদলে পুলিশের নিশানায় চলে আসেন অনুষ্ঠানের সংগঠকরা।
গত বছর ৬ জুন নাগপুরে গ্রেফতার হন সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, সোমা সেন এবং মহেশ রাউত। মুম্বই থেকে গ্রেফতার করা হয় সুধীর ধাওয়ালেকে। দিল্লি থেকে গ্রেফতার হন রোনা উইলসন। তারপর ২৮ শে অগাস্ট পুলিশ গ্রেফতার করে সুধা ভারদ্বাজ, অরুণ ফেরেরা, ভার্নন গঞ্জালভেস, গৌতম নওলাখা এবং ভারভারা রাওকে। পুণে পুলিশ আদালতে দাবি করে বলে, মাওবাদীদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ভিমা কোরেগাঁও থেকে দেশজুড়ে সংঘর্ষ শুরুর পরিকল্পনা ছিল ধৃতদের। মোদী সরকারকে উৎখাত করা এবং দেশে শাসন ক্ষমতা দখল করারও পরিকল্পনার কথা আদালতে জানায় পুণে পুলিশ। অতিরিক্ত চার্জশিটে নাম আসে মাওবাদীদের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক গণপতিরও। ধৃতদেরকে আরবান নকশাল বা শহুরে মাওবাদী বলে অভিহিত করা শুরু হয় তখন থেকেই। চার্জশিটে মাওবাদী ষড়যন্ত্রের উল্লেখ করলেও পরবর্তীতে পুণে পুলিশ তার কোনও প্রমাণ আদালতে দাখিল করতে পারেনি। এই অবস্থায় এখন আটকে রয়েছে ভিমা কোরেগাঁও মামলা। যদিও মামলার বিচারক বদলের পর ফের জামিনের আবেদন নিয়ে শুনানি হবে বলে আদালত সূত্রে খবর।

কেমন আছেন ধৃতরা
সুরেন্দ্র গ্যাডলিংকে নাগপুর থেকে গ্রেফতার করেছিল পুণে পুলিশ। তারপর থেকে পুণের ইয়েরওয়াড়া জেলেই বন্দি রয়েছেন মানবাধিকার কর্মী এবং আইনজীবী সুরেন্দ্র। পরিস্থিতি এমনই যে তিনি জেল কর্তৃপক্ষের কাছে সাইবার আইন এবং মানবাধিকার নিয়ে আরও পড়াশোনা করার আবেদন জানিয়েছিলেন। সেই আবেদন খারিজ করা হয়েছে। কারণ হিসেবে জানানো হয়েছে, গ্যাডলিং সাইবার আইন পড়ে জেলের কম্পিউটার হ্যাক করে ফেলতে পারেন। শারীরিকভাবে কাহিল সুরেন্দ্র গ্যাডলিংকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় তাঁর পরিবার। স্ত্রী মীনাল বলছেন, আর্থিক সমস্যা যেন চারদিক থেকে ঘিরে ফেলছে। মীনালের অভিযোগ, গত দু’মাস ধরে সুরেন্দ্র গ্যাডলিংয়ের মামলার শুনানিতে তাঁকে হাজিরই করেনি পুলিশ।
নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন সোমা সেন। পাশাপাশি বিভিন্ন মহিলা সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। তাঁর মেয়ে কোয়েলের আক্ষেপ, মায়ের সেলে একটা চেয়ারের জন্য তাঁকে এক বছর ধরে লড়তে হয়েছে। সম্প্রতি সোমা সেনের সেলে একটি চেয়ার দিয়ে গিয়েছে জেল কর্তৃপক্ষ। তাহলেই বুঝতে পারছেন বাকিটা কী অবস্থায় আছে, বলছেন পেশায় চিত্র পরিচালক কোয়েল সেন।
আদিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই করা গডচিরৌলির মহেশ রাউতের বোন মোনালির দাবি, দাদার গ্রেফতারির পর আমাদের জীবন অনেক বদলে গিয়েছে। গ্রামে অনেকেই এখন আর আমাদের সঙ্গে কথা বলেন না। আবার অনেকেই এসে পাশে দাঁড়াচ্ছেন, যাঁদের কাছ থেকে সমর্থন আসবে বলে আমরা ভাবতেও পারিনি। পেটের জটিল সমস্যায় ভোগা মহেশ রাউতের জন্য ওষুধ পর্যন্ত জেলে ঢুকতে দিচ্ছে প্রশাসন। এভাবে একটা মানুষকে চিকিৎসা না দিয়ে মেরে ফেলার চক্রান্ত চলছে বলেও অভিযোগ মোনালি রাউতের।
আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে দেশে অগ্রগণ্য রিপাবলিকান প্যান্থার্সের নেতা সুধীর ধাওয়ালে। তাঁর জন্য পুণের ইয়েরওয়াড়া জেল কর্তৃপক্ষ তৈরি করেছে এক নতুন নিয়ম। সুধীর ধাওয়ালের পরিজনদের দাবি, কেবলমাত্র রক্তের সম্পর্ক ছাড়া আর কাউকে জেলে সুধীরের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না।
ধৃতদের তালিকায় পঞ্চম তথা শেষ নাম রোনা উইলসনের। পিএইচডির ছাত্র রোনার বাড়ি কেরলে। তাই মা-বাবার পক্ষে পুণে এসে ছেলের সঙ্গে দেখা করা কঠিন। রোনা উইলসনের ভাই রয় উইলসনের বক্তব্য, দাদাকে গ্রেফতার করার খবর আমাদের পরিবারের পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন কাজ ছিল। কিন্তু তার চেয়েও কঠিন হচ্ছে, মিডিয়া ট্রায়াল সামলে স্বাভাবিক থাকা। দ্রুত দাদার মুক্তির আশা করছেন রয় উইলসন।

Comments are closed.